সন্দীপ মজুমদার, উলুবেড়িয়া: তিনি যেন এ যুগের যুগলপ্রসাদ! যিনি একক প্রয়াসে সৃষ্টি করতে পারেন এক একটি বনাঞ্চল। ডোমজুড় থানার রাজাপুরের বাসিন্দা কানু মাঝি। এক সময় দীর্ঘদিন তিনি বনবিভাগের অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন। সেই সময় সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বিভিন্ন প্রদেশে নিজের হাতে তিনি বনাঞ্চল গড়ে তুলেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের অবিস্মরণীয় চরিত্র যুগলপ্রসাদকে খুঁজে পাওয়া যায় ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের আশীর্বাদ-ধন্য কানু মাঝির মধ্যে।
যুগলপ্রসাদ বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছ সংগ্রহ করে নাঢ়া-বইহারের বন্ধ্যা মাটিতে মরুদ্যান গড়ে তুলেছিলেন। যুগলপ্রসাদের মতোই কানু মাঝিও বনকর্মীর দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে সবুজ রক্ষার তাগিদ উপলব্ধি করেছিলেন। তাই সবুজকে বাঁচানোর লক্ষ্য নিয়ে গত ৩০-৪০ বছর যাবৎ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েক সহস্রাধিক বৃক্ষরোপন করেছেন তিনি। আজ দেশের সর্বত্র বনাঞ্চলের উপরে যেভাবে সভ্যতার আঘাত আসছে তা দেখে বছর সত্তরের কানু মাঝি অত্যন্ত ব্যথিত। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে গলায় একরাশ আবেগ নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, “যে হারে অরণ্য ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে মানব সভ্যতাকেও ধ্বংসের মুখে পড়তে হবে। অবিলম্বে অরণ্য ধ্বংস বন্ধ করা দরকার। মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে আরও লক্ষ কোটি গাছ রোপন করতে হবে। না হলে প্রকৃতির অভিশাপ থেকে এই মানব সভ্যতাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।”
কানু মাঝি গাছকে নিজের সন্তানদের মতোই ভালবাসেন। যে কোনও গাছের উপরে আঘাত হতে দেখলে তিনি অশ্রু জলে সিক্ত হন। আক্ষেপের সঙ্গে তিনি জানান কেউ তাঁর কথা শুনতে চায় না। বৃক্ষছেদন রোধ করার বিষয়ে তিনি ছোট থেকে বড় সকলকেই সচেতন করতে চান। কিন্তু হতদরিদ্র কানু মাঝি এখন যে সমাজের নিতান্তই অবহেলিত এক ব্যক্তি! তাঁর কথার মূল্য দেওয়ার কার কী দায় পড়েছে?
[ আরও পড়ুন: প্লাবিত উত্তরবঙ্গে নেই সুখবর, আজও ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস হাওয়া অফিসের ]
রাজাপুরের নোনাকুন্ডু, উত্তর ঝাঁপড়দহে জন্মগ্রহণ করেন কানু মাঝি। বনদপ্তরের হাওড়া ডিভিশনে কাজ করার সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধানচন্দ্র রায় কানু মাঝির কাজে খুশি হয়ে তাঁকে পুরস্কার ও শংসাপত্র প্রদান করেন। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ কৃষ্ণকুমার মুখোপাধ্যায় জানান, কানুবাবু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন প্রদেশে অসংখ্য বৃক্ষরোপন করার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন। একেবারে প্রথম দিকেই তিনি ১১ হাজারের উপর বৃক্ষরোপন করার নজির স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন প্রদেশে আরও সহস্রাধিক গাছ লাগিয়েছেন। বিশিষ্ট শিক্ষক পলাশচন্দ্র পোড়েল বলেন আজ সমাজে স্বার্থান্বেষী মানুষদের ভিড়ে কানু মাঝিরা ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছেন। সমাজকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে হলে কানু মাঝিদের আজ বড় বেশি প্রয়োজন।
‘আরণ্যক’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যুগলপ্রসাদ চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন, “যুগলপ্রসাদ মরিয়া যাইবে, কিন্তু সরস্বতী হ্রদের জলে আজ হইতে শতবর্ষ পরেও হেমন্তে ফুটন্ত স্পাইডারলিলি বাতাসে সুগন্ধ ছড়াইবে, কিংবা কোনও-না-কোনও বনঝোপে বন্য হংসলতার হংসাকৃতি নীলফুল দুলিবে, যুগলপ্রসাদই যে সেগুলি নাঢ়া-বইহারের জঙ্গলে আমদানি করিয়াছিল একদিন একথা না-ই বা কেহ বলিল!” কানু মাঝিও একদিন অতীত হয়ে যাবেন, সভ্য মানুষেরা হয়তো জানবে না অরণ্য সৃষ্টিতে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা। কিন্তু হাজার হাজার মেহগিনি, আকাশমনি, শাল, সেগুন অথবা অশোক বৃক্ষরাজি মনে রাখবে কানু মাঝির কথা।
বনদপ্তরের অস্থায়ী কর্মী থাকার কারণে তিনি কোনও পেনশন পান না। চরম দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে বর্তমানে তিনি একটি অস্থায়ী চায়ের দোকান করে কোনও রকমভাবে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে সংসার চালান। ছাতা টাঙানো চায়ের দোকানটার ধারে মুখে স্মিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কানু মাঝিকে দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় বিভূতিভূষণের সেই অমোঘ বাণী, “এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে না। শুধুই চাষের ক্ষেত আর পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে।” রাজ্যজুড়ে অরণ্য সপ্তাহ পালনের মাঝে এই কানু মাঝিরাই আমাদের অনুপ্রেরণা৷
[ আরও পড়ুন: অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র যেন মরণফাঁদ, বাঁকুড়ায় ভেঙে পড়া বাড়িতেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.