কলহার মুখোপাধ্যায়, বিধাননগর : ফোনটা আসে ২৫ জানুয়ারি একটু বিকেলের দিকে। পদ্মশ্রী পাওয়ার খবরটা সরকারিভাবে তখনই প্রথম জানতে পারেন ডা: অরুণোদয় মণ্ডল। দিনটা আপনার জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল তাহলে। “তা কিছুটা বটে। তবে সোনা ফলবে কিন্তু ‘সুজনে’। পদ্মশ্রীর গোটা টাকাটাই চিকিৎসা কেন্দ্রের জন্য দান করে দেব।” উত্তরটা দিতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরি করলেন না ‘ডাক্তারবাবু’।
অগণিত রোগী তাঁর এই নামটা যে দিনে কতবার উচ্চারণ করেন তা গুনে বলা সম্ভব নয়। প্রতি সপ্তাহে শনি ও রবি। কখনও তারও বেশি। এই রোগীদের কাছে তাঁর নিত্য যাতায়াত। তিরিশ বছর প্রায়, একদিনও এই স্বেচ্ছা পরিশ্রমে কামাই হয়নি। জনা ৫০০ মানুষ মাইলের পর মাইল পথ উজিয়ে তাঁকে দেখাতে আসেন। আর ডাক্তারবাবু তাঁদের দেখতে ভোর সাড়ে চারটেয় বাড়ি থেকে বেরোন, ট্রেনে চেপে, নদী পেরিয়ে, বাসে দেড়ঘণ্টার জার্নি করে ভ্যানে চেপে গন্তব্যে পৌঁছন। আয়লার প্রবল আঘাত, বর্ষায় করাল ইছামতি বা শীতের কামড়, কোনও দিন একটুও টসকায়নি রোজনামচা। স্বেচ্ছা ডিউটিতে ছেদ পড়েনি একদিনও।
কোনওদিন রুটিনের অন্যথা হয়নি। পদ্মশ্রী পাওয়ার পরও হবে না। “বরং দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেল, বলুন?” হাসতে হাসতেই নিজের বাড়ির ড্রয়িং রুম বসে বললেন, ডা: অরুণোদয় মণ্ডল। তখন দেখলে কে বলবে, এই মানুষটাই দিন কয়েক আগে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মান, ‘পদ্মশ্রী’ পেয়ে গিয়েছেন। কেমন লাগছে? প্রশ্ন শুনে খানিকটা যেন আত্মবিস্মৃত ডাক্তারবাবু।
“যুবক বয়সে যখন ব্যাগ হাতে করে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ঘুরতাম, ৩০ বছর পারও করে দিলাম এই করতে করতে, তখন কি আর ভেবেছিলাম পদ্মশ্রী পাব? পেয়ে খুব ভাল লাগছে। কিন্তু এর আগে রাজ্যের কোনও সরকারই আমার কাজকে স্বীকৃতি দেয়নি। সাহায্য তো দূর অস্ত।”
সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এইটুকু কথাতেই অরুণোদয়বাবুর লড়াই এবং তা ঘিরে বঞ্চনার ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যায়। যে পথে হাঁটতে হাঁটতে পদ্মশ্রী পর্যন্ত পৌঁছেছেন, সেই পথটা কতটা দুর্গম? প্রতি শনি ও রবি ভোর সাড়ে চারটে। ঘুম থেকে উঠে দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে লোকাল ট্রেনে হাসনাবাদ। সঙ্গে ওষুধের ব্যাগ নিয়ে রাতুল রায় ও শম্ভু চক্রবর্তী। ইছামতির শাখা ডাঁসা পেরিয়ে বাসে লেবুখালি। তারপর রায়মঙ্গল নদী পার। তারপর ট্রেকারে চেপে আরও ৪৫ মিনিট রায়পাড়া। সেখানে রয়েছে ‘সুজন’। ডাক্তারবাবু প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাকেন্দ্র। যেখানে শনি ও রবি ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করেন।
সুজনে ৫০ টাকা দিয়ে একটি টিকিট করাতে হয়, ব্যস। তারপর রোগের চিকিৎসা থেকে শুরু করে তার ওষুধপত্র, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট, সব বিনামূল্যে। এত টাকা আসে কোথা থেকে? অরুণোদয়বাবু জানিয়েছেন, শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা, কিছু অসরকারি সংস্থা নিয়মিত টাকার জোগান দেয়। আর বিরাটিতে ৩০০ টাকা ফিজ নিয়ে রোজ নিজের চেম্বারে রোগী দেখেন অরুণোদয়বাবু। সে টাকার সিংহভাগ যায় সুজনে। এবার সেখানে পদ্মশ্রীর টাকার প্রবেশ।
অরুণোদয়বাবু জানিয়েছেন, সুন্দরবন অঞ্চলে মধুমেহ রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে হাইপারটেনশন এবং অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। নিরাপত্তা ছাড়া রাসায়নিক সার ব্যবহার ও লবণাক্ত জলের জন্য এই রোগের লক্ষণ বেশি। সরকারি সাহায্য তিনি কোনওদিনই পাননি। এই আক্ষেপের কথা শোনাতে শোনাতেই প্রসঙ্গক্রমে উঠে আয়লার সেই ভয়াবহ দিনের কথা। অরুণোদয়বাবু জানিয়েছেন, “জমা জলের ফলে কলেরা তখন মারাত্মক আকার নিয়েছে গ্রামে গ্রামে। প্রায় মহামারী অবস্থা। সরকার স্রেফ চেপে গিয়েছিল এই তথ্য।” প্রায় এক মাস সেখানে ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন গ্রামের একমাত্র ডাক্তারবাবু অরুণোদয় মণ্ডল। এখনও এই ৬৭ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফের ঘাঁটি গাড়ার। শনি-রবি শুধু নয়। কয়েকমাসের মধ্যে সপ্তাহের ৫ দিন সুজনে চিকিৎসা করার বিষয়ে মনস্থির করে ফেলেছেন। অবসরের বয়সে নতুন করে ডিউটি শুরু করতে চলেছেন সুন্দরবনের ডাক্তারবাবু।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.