সুমন করাতি, হুগলি: ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই…’ বাঙালির এমন আকুতি বিশ্বজনীন! এককথায় বলতে হলে, বৃষ্টি হলেও বাঙালির চা চাই, বৃষ্টি না হলেও চা চাই! শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, বাঙালির চা-ই ভরসা! তবে শুধু চা হলে চলবে না, সঙ্গে চাই চায়ের দোকানের আড্ডা। যেখানে এক কাপ চায়ে, চিন থেকে চিনি, আবার মঙ্গল অভিযান থেকে মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত, সব নিয়েই ঝড় তোলা যায়। কিন্তু যদি সেই দোকানে গিয়ে নিজেকেই চা বানাতে হয়! তবুও বাঙালির চা প্রেম বা আড্ডা কোনওটাই থমকে থাকে না, তা প্রমাণিত। কীভাবে? চলুন, আন্তর্জাতিক চা দিবসে এমনই এক চায়ের দোকানের গল্প জেনে নেওয়া যাক।
একটি চায়ের দোকান। সেখানে একজন ব্যক্তি চা-বানাচ্ছেন। সাধারণের দৃষ্টিতে তাঁকে দোকানের মালিক বা কর্মচারী বলে মনে হবে। কিন্তু, আদতে তা নয়। যিনি চা-বানাচ্ছেন, তিনি নিজেই একজন গ্রাহক। আন্তর্জাতিক এমনই এক চায়ের দোকানের হদিশ মিলল হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের কালীবাবুর শ্মাশানঘাটের সামনে। কিন্তু, একজন গ্রাহক কেন চা-বানাচ্ছেন। কারণ, এই দোকানের কোনও মালিক নেই। তাই স্থানীয় বাসিন্দারা এসে পালা করে চায়ের দোকান চালান। স্থানীয় খদ্দেররা নিজে হাতেই চা ঢেলে নেন।এমনকী, শ্মশানে আসা লোকজনকে চা পরিবেশনও করেন স্থানীয়রা। এই দোকানে এখনও মাত্র পাঁচ টাকায় পাওয়া যায় দু’কাপ চা।
যে যখন দায়িত্বে থাকেন, তাঁরাই সকালে-বিকেলে দোকান খোলেন ও বন্ধ করেন। বেচাকেনা শেষে সারাদিনের চা-বিস্কুট বিক্রির টাকা ক্যাশবাক্সে রেখে যান। সেই টাকা চায়ের দোকান চালাতেই খরচ করা হয় ।সেখানে লাভ-লোকসান বা ভাগবাটোয়ারার প্রশ্ন নেই। দিনের পর দিন স্থানীয়রা স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। শ্মশান লাগোয়া এই চায়ের দোকান থেকে প্রাপ্তি, পাড়ার গুটি কয়েক মানুষের সকাল-সন্ধের আড্ডা ও গল্প।
তবে, এই দোকানে শুরু থেকে চা বিক্রি হত না। এমনকি এই দোকান মালিকবিহীনও ছিল না। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, আড়াই শো বছরের পুরনো এই দোকান ঘরটি। শ্রীরামপুরে চাতরা বাজারে অবস্থিত এই চায়ের দোকানে আগে ঘট, কলসি বিক্রি হত। সময়ের সঙ্গে সেই দোকান উঠে যায়। পরিবারের কেউ আর সেই দোকান চালায়নি।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর, স্থানীয় এক ব্যক্তি নরেশ সোম চায়ের দোকান খোলেন সেখানে। প্রথম দিকে ঘুগনি, আলুর দম, চা বিক্রি হলেও বর্তমানে শুধু চা ও বিস্কুট বিক্রি হয় ৷ নরেশ সোমের মৃত্যুর পর স্থানীয়রাই দোকান চালানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রায় একশো বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে মালিকবিহীন দোকান। অবসর জীবনে কাটানো বয়স্ক মানুষজন এই দোকানে আড্ডা দেওয়া, চা-খাওয়ার সঙ্গে দোকানদারিও করেন।
তেমনই একজন আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছেন এই চায়ের দোকান। আগে বেসরকারি সংস্থার চাকরি করতেন। অবসরের পর এই দোকান সামলান। তিনি বলেন, “সকাল ন’টা থেকে আমি দোকানে থাকি। দুপুরে বন্ধ করে দিলেও আবার বিকেল তিনটে থেকে দোকান খুলি। সপ্তাহে সবদিন না-হলেও, বেশিরভাগ সময়টা এখানেই কাটাতে চলে আসি । আমার সময় শেষ হলে অন্যজন এসে দায়িত্ব নেয়। এখানে সকলেই পেনশন হোল্ডার।”
তিনি বলেন, “৬০ থেকে ৭০ বছরের সবাই এখানে চা খেয়ে আড্ডা দেন। কালীবাবুর শ্মশানঘাটের যাত্রীরা এই দোকানেরই খদ্দের। এছাড়াও আশেপাশের স্থানীয় লোক দোকানের চা খেতে আসেন। সারাদিনে প্রায় তিনশো কাপ চা বিক্রি হয়। এখানে কাজের লোক কেউ নেই। নির্দিষ্ট সময়ে এসে প্রত্যেকেই তাঁর দায়িত্ব সামলে যান।”
এভাবেই দোকান সামলান বিশ্বনাথ দে ৷ তিনি বলেন, “১০-১২ জন মিলে আমরা দোকান চালাই ৷ এই দোকানে কাস্টমার ফেরত যায় না ৷ যে যখন সময় পায়, সে এসেই দোকান সামলে যায় ৷ ভোর চারটে থেকে দোকান খোলে, চলে রাত দশটা পর্যন্ত ৷ তার মধ্যে শ্মশানঘাটের যাত্রীরা এলে, এগারোটা-বারোটা হয়ে যায় ৷ আমাদের কারও বিরক্তভাব নেই ৷ তাহলে অনেকদিন আগেই এই দোকান বন্ধ হয়ে যেত ৷ এখানে মালিক বলে কেউ নেই ৷ একজন শুধু দায়িত্বে থাকেন। সকলের বিশ্বাসের উপরেই এই দোকান চলে ৷ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই চায়ের দোকান সামলানোর জন্য এসে গিয়েছে ৷ এখানে চা-করার জিনিসপত্র পরিষ্কার করা থেকে, দুধ-চিনি আনা সবকিছুই করতে হয় সকলকে ৷” চা-দোকানের আরেক সদস্য অশোক চক্রবর্তী বলেন, “চায়ের দোকানের কিছুটা দায়িত্ব আমি নিয়েছি ৷ আর যে যখন থাকে, সেই দায়িত্ব নিয়ে দোকান চালায় ৷ দোকানে বিক্রির টাকা ক্যাশ বাক্সে থাকে ৷ সেখান থেকেই খরচ করা হয় ৷ আমি চাকরি করি বলে সবসময় থাকতে পারি না। সকালে আটটা পর্যন্ত থাকি। আবার সন্ধে বেলায় এসে দোকানের কেনাকাটা করি।”
আট বছর ধরে এই দোকানের চা খাচ্ছেন বলরাম চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক থাকে। কিন্তু, চায়ের কোয়ালিটি একই রয়ে যায়। ৫ টাকার চা তিন-চারজন মিলে খাওয়া যায়। এই দোকানে এলে খদ্দেররাই নিজেদের ইচ্ছামতো চা নিয়ে, টাকা দিয়ে চলে যায়।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.