ধীমান রায়, কাটোয়া: প্রায় আড়াই মাস আগে পুকুর সংস্কারের কাজ করার সময় উদ্ধার হয়েছিল প্রাচীন শিলামূর্তি। যেটি শাস্ত্রীয় মতে ‘অষ্টভূজাপিতা মরিচী’ দেবীর মূর্তি। পুকুরের পাঁকের তলা থেকে উদ্ধারের পর গৃহস্থবাড়িতে এনে সেই মূর্তিটি ঠাকুরঘরে রেখে পুজোও করছিলেন পরিবারের লোকজন। কিন্তু ওই মূর্তি নিয়ে এমন বিড়াম্বনায় পড়েছেন পূর্ব বর্ধমান (Purba Bardhaman) জেলার দাঁইহাটের বেড়াগ্রামের ঘোষ পরিবার যে তাঁরা সেটি সরকারের হাতে তুলে দিতে একপ্রকার তৈরি। ব্যপারটা ঠিক কী?
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৫ মার্চ মণ্ডলহাট থেকে দাঁইহাট পুরসভা যাওয়ার রাস্তায় একটি পুকুরের পাঁক তোলার সময় প্রায় সাড়ে চার ফুট উচ্চতার এই মূর্তি উদ্ধার হয়। বেড়াগ্রামের বাসিন্দা উদয় ঘোষ, দিলীপ ঘোষরা মূর্তিটি নিজেদের বাড়িতেই রেখে দেন। আর মূর্তিটি বাড়িতে আনার পর থেকেই ঘোষবাড়িতে ঘটে যায় একের পর এক অঘটন। পরিবারের সদস্য মমতা ও বন্দনা ঘোষদের কথায়, “দেবীর মূর্তিটিতে আমরা নিয়মিত ফুল-জল, ধূপধুনো দিয়েছি। কিন্তু মূর্তিটি আনার তিনদিনের মধ্যেই আমাদের বাড়ির চারটে মোষ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ১০ দিন পার হতে না হতেই আমাদের বাড়ির ছেলে বাসুদেব(৩০) ঘরের চাল ছাওয়ানোর সময় পড়ে যায়। এখনও সে বিছানায় শয্যাশায়ী। তিনদিন আগে আমাদের বাড়িতে বজ্রপাত হয়েছে। বাজের আওয়াজের কারণে বাড়ির একজন শিশু কানে শুনতে পাচ্ছে না। আমাদের ধারণা দেবীমূর্তিটি আনার পর থেকেই এইসব অঘটন ঘটছে। তাই আমরা মূর্তি বাড়িতে রাখতে চাই না।” দিলীপ ঘোষ, উদয় ঘোষরা বলেন, “আমাদের পরিচিত অভিজ্ঞ কয়েকজন বলেছেন, এই মূর্তির পুজো পদ্ধতি শাস্ত্র মেনে হচ্ছে না। তাই এইসব ঘটছে। আমরা তাই আর ঝামেলা বাড়াতে চাই না। তাছাড়া মূর্তিটি অনেক মূল্যবান। তাই এটি সরকারিভাবে সংরক্ষণের আবেদন করেছি।”
ইতিহাস গবেষকরা জানাচ্ছেন, প্রায় ১৩০০ বছরের প্রাচীন এই দেবীমূর্তিটি শাস্ত্রের ভাষায় ‘অষ্টভুজাপিতা মরিচী’। দেবীর তিনটে মাথা আর আটটি হাত আছে। দেবীর প্রতিটি মুখে আছে তিনটে করে চোখ। দেবীর মধ্য মুখটি শান্ত। দেবীর ডান দিকের মুখ ক্রুদ্ধ ভঙ্গিমায়। আর দেবীর বাঁ দিকের মুখাবয়ব বরাহ আদলের। দেবীর আটটি হাতে থাকে সূঁচ, সুতো, অঙ্কুশ, রজ্জু, তীর, ধনুক, বজ্র এবং অশোক গাছের ডাল। সম্পূর্ণ মূর্তিতে দেবী দাঁড়িয়ে থাকেন একটি রথের উপর আর সেই রথটা টেনে নিয়ে যায় সাতটা বরাহ। দেবীর রথের চাকার তলায় থাকে রাহু। দেবীকে ঘিরে থাকেন আরও চারজন দেবী। পাল যুগে বৌদ্ধধর্মের উত্থানের সময় এই মরিচী মূর্তির উপাসনার চল ছিল বলে জানান ইতিহাসবিদরা। দাঁইহাটের বাসিন্দা ইতিহাসবিদ লেখক অশেষ কয়াল বলেন, “যেহেতু মূর্তিটি বাড়িতে আনার পর থেকে ওই পরিবারে একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে তাই তারা মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছেন। এটা কুসংস্কার হতেই পারে। তবে পুরাতাত্ত্বিক মূল্যের নিরিখে ওই দুষ্প্রাপ্য মূর্তিটি সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করে রাখা উচিত।” এবিষয়ে কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বেড়াগ্রামের একটি পরিবারের পক্ষ থেকে প্রাচীন দেবীমূর্তি উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগারে যাতে রেখে দেওয়া যায় তা নিয়ে কথাবার্তা চলছে।” এ বিষয়ে ‘দ্য ফ্রি থিংকিং হিউম্যনিষ্ট’ নামে একটি সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিষয়টি শুনে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ কাকতালীয়। ওই মূর্তি বাড়িতে রেখে দেওয়ার সঙ্গে ওই পরিবারের ঘটনাগুলির কোনও সম্পর্ক নেই। বাড়িতে বজ্রপাত কেন হল, তা বাড়ির চারপাশের পরিবেশ দেখে বোঝা যাবে।অযথা কুসংস্কারের বশবর্তী না হওয়াই কাম্য।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.