গৌতম ব্রহ্ম: ‘করোনার হাত থেকে বাঁচলেও অনাহারে মরব।’ কোদালটা মাটিতে নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অজিতকুমার ভৌমিক। ষাট পেরিয়েছে বছর সাতেক আগেই। তিন পুরুষ ধরে ফুলের চাষ। জানুয়ারিতেও ভাল লাভ দিয়েছে গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগঝুঁটি। গোলাপ দেড় টাকা, চন্দ্রমল্লিকা তিন টাকা করে দাম পেয়েছে। এবছর? মাঠের ফুল মাঠেই ঝরছে। কোদাল হাতে নিয়ে ফের কোপ দিলেন অজিতবাবু। নিজের হাতেই তছনছ করছেন সাজানো বাগান! ‘কচুকাটা’ করছেন ফুলগাছ। অজিতবাবু একা নন। মাঠে হাজির স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ, ছোট্ট নাতিও।
মঙ্গলবার থেকে গাজন শুরু। লকডাউনের জন্য এবার গাঁয়ে কোনও উৎসব হচ্ছে না। ধুতির খুট দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে অজিতবাবু বললেন, “ব্যাংক থেকে দু’লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে চাষ করছি। লকডাউন না হলে পয়লা বৈশাখের আগেই টাকা উঠে আসত। সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেল।” মন খারাপ অজিতবাবুর পুত্রবধূ কল্যাণীর। জানালেন, “গাজনের সময় ছেলেটাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিতে পারলাম না। সারাদিন মাঠে পড়ে থেকে কাজ করেছি। ফল শূন্য।” চোখের কোণ টলমল করে উঠল জল। অজিতবাবুর খেত থেকে একটু এগিয়ে যেতেই দেখা শ্রীমন্ত সাহুর সঙ্গে। স্কুটি দাঁড় করিয়ে নিয়ে গেলেন নিজের ফুলখেতে। ডাঁই হয়ে আছে চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা। বললেন, “অনেক টাকা ঢেলেছি জমিতে। সারের দামটুকুও উঠল না। সরকার ক্ষতিপূরণ না দিলে পাশকুঁড়ার মহৎপুরের ফুলচাষীরা সত্যিই বিপদে পরে যাবেন।”
শুধু মহৎপুর নয়, বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে গোটা পাঁশকুড়া। গুড়তলা থেকে বাকুলদা, সব গ্রামেই এক ছবি। সর্বত্র মাঠেই শুকিয়ে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে ফুল। মহৎপুর থেকে গুড়তলা যাওয়ার পথেও সেই এক দৃশ্যের অবতারণা। ফুলখেতগুলি সব শুকিয়ে কাঠ। ছাতারে পাখির দল ঝাঁক বেঁধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে খেতে। খেতের উপর কোনও রোদনিবারক আচ্ছাদন নেই। “কী লাভ রেখে। লকডাউনের দু’দিন পরেই সব সরিয়ে নিয়েছি।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে গেলেন গুড়তলার কৃষ্ণ মণ্ডল। খেতে ঢোকার মুখেই নিহত গোলাপের স্তূপ। জানালেন, “তিন বিঘে জমিতে এবার গোলাপচাষ করছি। চিনে বাদাম কম লাগিয়েছি। উলটোটা করলেই দেখছি ভাল হত।” অজিতবাবুরা ফুলগাছ কেটে ফেলে সবজি চাষের পরিকল্পনা নিয়েছেন। শ্রীমন্ত জানালেন, “রাত দেড়টায় উঠে সাইকেল কিংবা মোটরসাইকেলে পাঁশকুড়া স্টেশন। সেখান থেকে তিনটে পনেরোর লোকাল ধরে হাওড়া। সবজি চাষ হলে আর ভোরে উঠতে হবে না।”
যদিও সন্ধের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে জানিয়ে দেন, “দুধ নষ্ট হচ্ছে জেনে দিনের একটা সময় মিষ্টির দোকান খুলে রাখতে বলেছি। খবর পেলাম ফুলও নষ্ট হচ্ছে। কাল থেকে ফুলের দোকান খোলা থাকবে। আমাদের একটা দিন সময় দিন। পরশু থেকে জেলার ফুলচাষিরা কলকাতায় ফুল আনতে পারবেন।”
এই খবরের পরেই কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরে পাঁশকুড়া, উলুবেড়িয়ায়। রাজ্যের ফুলবাজারগুলি খোলার তোড়জোড় শুরু হয়। ‘সারা বাংলা ফুলচাষি ও ফুলব্যবসায়ী সমিতি’-র সাধারণ সম্পাদক নারায়ণচন্দ্র নায়ক মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই সিদ্ধান্তে ফুলচাষীরা অনেকটাই উপকৃত হবেন। উল্লেখ্য, ফুলবাজারগুলি রোজ কয়েক ঘণ্টার জন্য চালুর আবেদন জানিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে এবং উদ্যানপালন দপ্তরের মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
যদিও ফুলচাষীদের একাংশের ধারণা, এই সিদ্ধান্তে পরিস্থিতির খুব একটা বদল হবে না। দেউলিয়ার ফুল ব্যবসায়ী মলয় পাড়ুইয়ের পর্যবেক্ষণ, বাজার খুলে খুব একটা লাভ নেই। খদ্দের কোথায়? পুজো-পার্বণ, উৎসব-অনুষ্ঠান সব তো বাতিল। ফুল কিনবে কে? নিত্যপুজোর ফুল বিক্রি করে তো আর পেট ভরবে না।” বেলি, জুঁই রজনীগন্ধা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, টগর জবা, গ্লাডিওলাস, গাঁদা। পাঁশকুড়ায় মূলত এই ফুলগুলি চাষ হয়। মলয়বাবু জানালেন, রজনীগন্ধার এক একর জমিতে ক্ষতি ৩ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। বাকি ফুলগুলিরও হিসাব তৈরি করা হচ্ছে। সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করলে ফুলচাষীদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.