বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: গাধার পিঠে দেবতা। পাহারাদার বৃটিশ সিপাই। রয়েছেন রাজা-রাণী। অপদেবতার উপদ্রব থেকে বাঁচতে কালীপুজোর পরদিন এই ‘কাঁইতাকূড়া’ দেবতার পুজো হল জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির জরদা নদী পাড়ে। পুরনো প্রথা মেনে পুজো দিলেন রাজবংশী সমাজে ‘দেউসি’ নামে পরিচিত পুরোহিত।
স্থানীয় মহলে নদী বক্ষে গভীর গর্ত ‘কূড়া’ নামে পরিচিত। ‘কাইতা’ অর্থাৎ কাত করা। দীর্ঘদিন থেকে জরদা নদী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ওই ধরনের কুড়াগুলো মরণ ফাঁদের মতো। একবার আটকে গেলে নিস্তার নেই। মৃত্যু অবধারিত। ফি বছর জরদায় তিন থেকে চারজনের মৃত্যু হয় এভাবে। ওই কারণে বিপদ এড়াতে সম্প্রতি প্রশাসনের তরফে সতর্কতা জারি হয়েছে। নদীতে ডুবুরি নেমেও দেহ উদ্ধার করতে হিমশিম হচ্ছে। এমন ঘটনা ঘিরে ক্রমশ রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। এদিকে জরদা নদী পরিচিত হয়েছে ‘মানুষ খেকো’ নদী নামে। অথচ শৈব তীর্থ জল্পেশ ছুঁয়ে যাওয়া কলোখাওয়া এবং বাগজান নামে দুই নদী মিলিত হয়ে তৈরি জরদা। যা পুরাণে পরিচিত পুণ্যতোয়া ‘জটোদ্ভা’ নামে। ওই পবিত্র নদী কালক্রমে ভয়ংকর হয়ে উঠতে প্রচলিত হয়েছে অপদেবতার কারসাজির রকমারি গল্প। সেই সঙ্গে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ পুজোর। যদিও গবেষকদের মতে এখানে ভূত-প্রেত অথবা অপদেবতার কোনও বিষয় নেই।
ময়নাগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রধান মধুসূদন কর্মকার জানান, নদীতে ফানেল আকৃতির জলের ঘুর্ণিপাকের জন্য সুরঙ্গের মতো গভীর গর্ত তৈরি হয়। সেখানে জল পাক খেয়ে গর্তের ভিতরে টানতে থাকে। ওই কারণে একবার পাকে কেউ আটকে গেলে ক্রমশ গর্তে তলিয়ে যেতে থাকে। বড় সাতারু হলেও কিছু করার থাকে না। দু’একদিন পর দেহ জলে ভাসে। কিন্তু গবেষকদের ব্যাখ্যা থাকলেও শুনছে কে? স্থানীয়দের মনে জাঁকিয়ে বসেছে অপদেবতার তত্ত্ব।
স্থানীয় বাসিন্দা ৯৪ বছরের প্রবীণা সবিতা গুপ্ত জানান, অধুনা ময়নাগুড়ি শহরের গোবিন্দ নগর অর্থাৎ ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ওই পুজো বৃটিশ আমলে চালু হয়েছে। আদিতে ছিল খড়ের ছাউনি। রাজবংশীদের গ্রাম দেবতার থান। তার শ্বশুরমশাই ব্রজেন গুপ্ত ছিলেন বৃটিশদের সার্ভেয়ার। এখানে জমি জরিপ করতে এসে গ্রাম দেবতার থানটি দেখেছিলেন। পরে স্থানীয় জোতদার চেরুমোহন রায়ের পরিবারের এক দুর্ঘটনার পর গ্রাম দেবতার থান ‘কাঁইতাকূড়া’ মণ্ডপ হিসেবে পরিচিত হয়। পুজো মণ্ডপের পাশে জরদা নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এখানেই জলের তলে রয়েছে কাত হয়ে থাকা গভীর কূড়া। স্নান করতে নেমে যেখানে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আশির দশকেও নদী সংলগ্ন গোবিন্দ নগরের ওই এলাকা বাঁশ, আম-কাঠাল বাগান ও ঝোপজঙ্গলে ভরা ছিল। লোকসংস্কৃতি গবেষক দীনেশচন্দ্র রায় মনে করেন, সম্ভবত এমন গা ছমছম করা পরিবেশ এবং পর পর মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্ক থেকে কল্পনায় অদ্ভুত দর্শনের দেবতার আবির্ভাব হয়ে থাকতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.