সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: আয়লা সেভাবে প্রতিহত হয়নি। কিন্তু বুলবুল অনেকটাই আটকে গেল অরণ্যে। সুন্দরী, গরান, গেঁওয়ার শিকড়, শাখাপ্রশাখার প্রতিরোধে ততটা তাণ্ডব দেখাতে পারল না বুলবুল। ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে সুন্দরবনকে এযাত্রা রক্ষা করল ম্যানগ্রোভ অরণ্য। শনিবার রাতভর দুর্যোগের পর রবিবার সকালে আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি হতে সুন্দরবনের প্রকৃতি অর্থাৎ ম্যানগ্রোভ জঙ্গলকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন পরিবেশবিদরা।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে বৃক্ষরোপণের উপযোগিতা নতুন করে বলার কিছু নেই। যা করার, তা হল স্মরণ। কীভাবে গাছপালা ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করতে পারে, এমন সংকট মুহূর্তে তা মনে করা উচিত আমাদের সকলের। নগরায়নের হিড়িকে ক্রমাগত গাছ কেটে ফেলতে বা জলাজমি বুজিয়ে ফেলতে আমরা এক মুহূর্তও ভাবি না। অনায়াসে তা করে ফেলি। কিন্তু তার সুদূরপ্রসারী বিপদ যে কতখানি, বোঝা গেল বুলবুলের আগমনে। নেহাত কঠিন, দৃঢ় শিকড়ের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছগুলি সুন্দরবন দ্বীপ ঘিরে রয়েছে বলে এই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের যতটা তাণ্ডব দেখানোর ক্ষমতা ছিল, তা পুরোটা দেখাতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে একবার ম্যানগ্রোভের বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া যাক। ভারত-বাংলদেশের সীমান্তে গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের ব-দ্বীপ অঞ্চলে সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ প্রকৃতির গাছের মূল বৈশিষ্ট্য এই যে, এদের ফলের মধ্যেই বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে, যা মাটিতে খসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রোথিত হয়ে শিকড় ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই এদের শিকড়ের এত জোর। যা ভূমিক্ষয় রোধ এবং যে কোনও ঝঞ্ঝা থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম। সুন্দরবন এলাকায় শতাধিক গাছের মধ্যে অন্তত ২৮ প্রজাতির গাছ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির। যা গোটা বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
পরিবেশবিদ অর্ক চৌধুরীর কথায়, ‘জল আর স্থলভূমির মধ্যে সবুজ দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায় এই ম্যানগ্রোভ। এই গাছের শিকড় ভূমিকে জলের তীব্র তোড় থেকে রক্ষা করে, মাটির ভারসাম্য বজায় রাখে। মোহনা এলাকায় একেবারে মাটির ভরকেন্দ্র এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য।’ এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৯৯ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ওড়িশার পারাদ্বীপের উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সমুদ্র সৈকতের বিস্তীর্ণ ঝাউগাছের জঙ্গল কাটা হচ্ছিল চিংড়ি চাষের জন্য। সমুদ্রের জল আটকে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। তাই পারাদ্বীপ এলাকায় সমুদ্র এগিয়ে এসেছিল প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার।’ অর্থাৎ গাছ কেটে ফেলার যে বিপদ, তা সেবার টের পেয়েছিল পারাদ্বীপ এবং লাগোয়া অঞ্চল। সেভাবেই প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় আমরা হয়ত টের পাব প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার উপযোগিতা। কিন্তু পরে আবার তা বিস্মৃত হতেও বেশি সময় লাগবে না।
তবে কেন আয়লার দাপট থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে পারেনি ম্যানগ্রোভ? তার উত্তর হিসেবে আসছে কয়েকটি তথ্য। প্রথমত ২০০৯ সালে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় আয়লার চেয়ে এবছরের বুলবুলের শক্তি বেশ খানিকটা কম ছিল। যে পথে সুন্দরবনে আয়লা আছড়ে পড়েছিল, তার উলটোপথে এসেছে বুলবুল। আবার আয়লার সময় নদীতে জোয়ার ছিল। তা ঝড়বৃষ্টির দোসর হয়ে দাঁড়িয়ে যথেচ্ছভাবে তছনছ করে দিয়েছে দ্বীপ অঞ্চলকে। আর বুলবুলের আগমনকালে ভাটা ছিল। তাই জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা কমে গিয়েছিল। এই প্রাকৃতিক আনুকূল্যে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা আয়লার সময় ছিল না। ফলে যে কোনও মোহনা অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে ম্যানগ্রোভের গুরুত্ব অপরিসীম।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.