সুমিত বিশ্বাস, বাঘমুন্ডি(পুরুলিয়া): তখন বয়স ৩৫। মার্কিন মুলুকে ছৌ মঞ্চ কাঁপানোর সুযোগ এসেও নির্বাচনে বাদ পড়ে তাঁর নাম। চোখের জল নিয়ে ঘরে ফিরে এসে শপথ নিয়েছিলেন নিজের ছৌ নাচের ওপর ভর করেই বিদেশ যাবেন। তার কয়েক বছর পরেই বিদেশ যাত্রা করেছিলেন তিনি। শুধু নৃত্যকলার জন্য নয়। ছৌ মুখোশের কাজ নিয়েও তিনি স্পেন পাড়ি দেন। আর তারপরেই একের পর সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ উত্তরন। কয়েকমাস আগে দিল্লি ঘুরে এসে বলেছিলেন, পুরস্কারটা তিনি পাবেনই। কিন্তু জীবদ্দশায় তা হয়নি ঠিকই। মরণোত্তর পদ্মশ্রীতেই গর্বিত নেপাল সূত্রধরের পরিবার। সর্বোপরি ছৌ মুখোশ গ্রাম চড়িদা।
১৯৮১। তারপরে ১৯৮৩। এরপর দীর্ঘ ৪১বছরের খরা কাটিয়ে আবার পদ্মশ্রী ঘরে তুলল পুরুলিয়া। বলা উচিত ছৌ ভূমি পুরুলিয়া। এই শিল্পকলার কারণেই যে তিন পদ্মশ্রী এই জেলার। ১৯৮১ সালে এই বাঘমুন্ডির অযোধ্যা পাহাড়তলির চড়িদার গম্ভীর সিং মুড়া। তারপর ১৯৮৩-তে বরাবাজারের আদাবনা গ্রামের নেপাল মাহাতো। আর ২০২৪-এ এই চড়িদা-রই নেপাল সূত্রধর। প্রায় ৫০ বছর ধরে ছৌ নৃত্যকলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্পেন, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, স্কটল্যান্ডে গিয়ে ছৌয়ের মঞ্চ কাঁপান। হাতে-কলমে মুখোশ তৈরি করে দেখান। একাধিক কর্মশালায় অংশ নেন। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে প্রায় ৭০টি নাচের দলকে প্রশিক্ষণ দেন। মাত্র চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ নেওয়া নেপালবাবু আট বছর বয়স থেকে বাবা জগিন্দর সূত্রধর ও ঠাকুরদা সৃষ্টিধর সূত্রধরের কাছ থেকে মুখোশ বানানোর কাজ শেখেন। আর মা সুচিত্রা দেবী ছিলেন ছৌ ওস্তাদ। প্রয়াত শিল্পী নেপাল চন্দ্র সূত্রধরের বাড়িতেই ছিল ছৌয়ের আখড়া। সেখানেই আসত পদ্মশ্রী প্রাপ্ত গম্ভীর সিং মুড়ার ছৌ নাচের দল। সুচিত্রা দেবীর তত্ত্বাবধানে হতো পালা রচনা, নাচ প্রদর্শন। তাঁর কাছ থেকেই হাতেখড়ি হয় প্রয়াত শিল্পীর।
সামান্য কাঠের কাজ করে কোনওভাবে সংসার চালাতেন বাবা যোগিন্দর সূত্রধর। কিন্তু পরিবার জুড়ে শুধুই ছিল এই নৃত্যকলা। তবে আগে এমন মুখোশ ছিল না মুখে। খড়িমাটি, রঙ মেখেই চলতো নাচ। পরে বীররসের এই নাচে আসে মুখোশ। কী না সাজতেন নেপালবাবু। দুর্গা, শিব, কার্তিক, মহিষাসুর গণেশ। সব চরিত্রেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতেন। গাইতেন ঝুমুর। সাধারণভাবে কথা বলতে প্রাসঙ্গিক বিষয়কে সামনে এনে গান গাইতে শুরু করে দিতেন তিনি। বড় ছেলে কাঞ্চন সূত্রধরের কথায়, “তখন আমরা ছোট ছিলাম। পরিবারের অবস্থা একেবারেই ভালো ছিল না। এমনও দিন গেছে এক বেলা খেয়েছি। আরেক বেলা খাবার জোটেনি। কখনও সারা দিনে আধপেটা খাবার জুটতো। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই বসত ছৌ নাচের আসর। ধামসা বাজলে ওই ছোট বয়সেও শরীরে কেমন যেন একটা গুরগুরানি হত। বাবার মতো নাচতে হয়তো পারি না। কিন্তু মুখোশ তৈরিটা তাঁর কাছ থেকেই শেখা। আর সেই মুখোশ বানিয়েই এখন আমাদের পেট চলছে।”
আর স্ত্রী সুন্দরা সূত্রধর বলেন, “একবার ছৌ নাচে বিদেশে যাবার জন্য নির্বাচনে বাদ পড়ে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন উনি। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি একাই বিদেশ যাবেন। আর সেই প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছিল। কয়েক মাস আগেও তিনি বলেছিলেন পুরস্কারটা তিনি পাবেনই। কী পুরস্কার আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। পুরস্কারটা পেলেন বটে। কিন্তু মানুষটাই নেই। খুবই খারাপ লাগছে। ওই মানুষটা যদি আজ থাকত তাহলে কত যে ভালো লাগত বলে বোঝাতে পারবো না। “
গতবছর ১ লা নভেম্বর তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তবে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি হাঁপানিতে ভুগছিলেন। গ্রামের মানুষজনের কথায়, নেপালবাবুকে তো শিল্পীর মর্যাদা দিতে কেউ চাইতেন না। নিজের শিল্পকলার জোরেই তিনি শিল্পীর মর্যাদা নিয়েছেন। তার কৃষ্ণলীলা ঝুমুরে বিভোর হয়ে যেত এই মুখোশ গ্রাম। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে গিয়ে টানা ১৮ ঘণ্টায় ২৫ ফুটের রাবণ তৈরি করে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বছর নয়েক আগে। আজও মার্কিন মুলকের মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে তাঁর হাতে তৈরি ২২ ফুটের রাম-লক্ষণ-সীতা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.