সংগ্রাম সিংহরায়, শিলিগুড়ি: লকডাউনের জেরে লাটে উঠেছে ব্যবসা। সীমিত সময় বাজার খোলা থাকায় মিলছে না উদ্বৃত্ত। ফলে ফেলে দেওয়া বাড়তি খাবার নেই। ফলে বছরভর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো গবাদি পশুর খাদ্য ভান্ডারে টান পড়েছে। খাবারের খোঁজে হঠাৎ দুটি গরু হন্যে হয়ে দরজা ধাক্কা দিয়েছিল মহাকালপল্লির কর্মবীর ওঝার বাড়িতে। ধর্মভীরু কর্মবীরবাবু এমনিতেই গরুকে মাতা হিসেবে পুজো করেন। তার ওপর নিজের বাড়ির দরজায় খাবারের আশায় আশা গোমাতাকে কীভাবে ফেরাবেন, ফলে ওই দুটি গরুকে ঘরে যা ছিল তা দিয়ে সেবা করতে কার্পণ্য করেননি। ক্রমশ গরুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। দুটি থেকে তিনটি, তা থেকে পাঁচটি। এভাবে এখন রোজ গড়ে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটা গরু তাঁর বাড়িতে বিকেল চারটে বাজলেই হাজির হয়ে যাচ্ছে। আর একটিকেও ফেরাবেন না ঠিক করেছেন কর্মবীরবাবু এবং তাঁর পরিবার।
তিনি নিজেই বিভিন্ন সেবামূলক কাজে লোকজনের সঙ্গে শহর চষে বেড়াচ্ছেন। ফলে বাড়িতে থাকেন তাঁর দুই ছেলেমেয়ে আয়ুষ এবং অঙ্কিতা। তাঁরাই এদের খাওয়ানোর ভার নিয়েছেন। প্রতিদিন আলাদা করে এই গবাদি পশুর জন্য তৈরি হচ্ছে গম সেদ্ধ, খড় সেদ্ধ, সঙ্গে আখের গুড়। অভাবের বাজারে চেটেপুটে খেয়ে তারপরই নিজেদের ঠিকানায় চলে যাচ্ছে অবলারা। তাদের এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে কর্মবীরবাবুর কাকিমা রেণুদেবীও। তাঁদের গবাদি পশুর খাবার কিনতে অর্থ সাহায্য করেছেন তিনি। ফলে গোটা পরিবার সকাল থেকেই লেগে পড়েছেন। নিজেদের পাশাপাশি এই অবলা প্রাণগুলি বাঁচাতে কর্মবীরবাবু জানালেন, “বছর দশেক আগে গ্রামে গিয়ে গরুর খাবার কীভাবে বানাতে হয় তা শিখেছিলাম নিছক খেয়ালে। সেটা এভাবে কাজে লেগে যাবে ভাবতে পারিনি।”
তিনি জানান, ২৫ মার্চ বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ দু’টি গরু তাঁর বাড়ির গেটে টানা শিং দিয়ে গুঁতো মেরে যাচ্ছিল। আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে তাদের দেখে বুঝতে পারেন বোধহয় খিদে পেয়েছে। বাড়িতে থাকা শাকপাতা, মুড়ি তাদের দেন তিনি। পরদিন ফের একই সময়ে হাজির হয়ে যায় ওই জুটি। এরপর নিয়মিত চলতে থাকে তাদের আনাগোনা। ক্রমশ সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে এক সপ্তাহের মধ্যে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশটি গরুতে দাঁড়ায়। এখন যা পরিস্থিতি যতদিন লকডাউন চলবে তিনি এভাবেই তাদের সেবা করে যাবেন বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি উৎসাহে ভরপুর ছেলেমেয়েও। তারাও জানিয়েছে, আমরা বিষয়টি উপভোগ করছি। পাশাপাশি যখন পেটপুরে খেয়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকায় অবলা প্রাণীগুলি, তখন বিলক্ষণ বুঝতে পারি। একটা অদ্ভুত তৃপ্তি কাজ করে তখন।
বছরভর খাবারের কোনও অসুবিধে হয় না। রাস্তায় ঘুরতে দেখলেই গোমাতার সেবায় পিছিয়ে আসেন না কেউই। বিশেষ করে শহরের বাজারগুলিতে ঘুরলেই মিলে যায় সারাদিনের খাবার। দিনের বাজার শেষে কখনও বাঁধাকপি, ফুলকপি, আলুটা, মুলোটা মিলতে অসুবিধে হয় না। টানা লকডাউনে এখন বাজার বসছে কম। উদ্বৃত্ত মিলছে আরও কম। জিনিসপত্রের যোগান নেই। তাই ফেলে দেওয়ার বিলাসিতা দেখাচ্ছেন না কেউই। এই পরিস্থিতিতে গবাদি সেবায় এগিয়ে শহরের কর্মবীরই এখন ধর্মবীর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.