পলাশ পাত্র, তেহট্ট: আর কোনও দিন সে ফিরে আসবে না। পুলওয়ামার ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলা তাঁকে প্রিয়জনদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। বোন ঝুম্পার কোনওদিন আর ভাইফোঁটা নেবেন না সুদীপ। ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় শহিদ নদিয়ার সুদীপ বিশ্বাসের পরিবারে আজকের দিনে শুধুই শূন্যতা।
আজ ভাইফোঁটা। হিন্দুদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। বোনেরা ভাইদের দীর্ঘায়ু কামনায় প্রার্থনা করে। কপালে ফোঁটা দিয়ে বোনের মন্ত্র উচ্চারণ করেন – ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।/যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।/ যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর/আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর।’
ছবির মতো ভেসে আসা দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে ঝুম্পা কেঁদে ওঠে। বলেন, ‘নিজের দাদার আয়ুই যখন বাড়িয়ে দিতে পারলাম না, তাকে ধরে রাখতে পারলাম না, তখন আমি আর কাউকে ভাইফোঁটা দেব না।’ অথচ ভাইফোঁটার দিন মানেই বিশ্বাস পরিবারে অন্য এক সময়। এক আলোর বৃত্ত। একসঙ্গে জেঠতুতো ভাইবোন, আত্মীয়-কুটুম সকলে মিলে সে এক আনন্দময় দিন। দাদাদের একসঙ্গে বসিয়ে ভাইফোঁটা দিতেন ঝুম্পা। ধান, দুর্বার শীষের সঙ্গে প্রদীপের শিখা, উলুধ্বনিতে বাড়ি গমগম করত। এই একটা দিনে দাদা, ভাই, বোন, দিদিদের মধ্যে আলাদা মেজাজ গড়ে ওঠে। থুড়ি উঠত। এবছর থেকে গোটা ছবিটাই পালটে গিয়েছে। আর কোনওদিন এমন সমাগম হবে না নদিয়ার হাঁসপুকুরিয়ার এই বাড়িতে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় শহিদ হন পলাশিপাড়া থানার হাঁসপুকুরিয়া গ্রামের তিলিপাড়ার সুদীপ বিশ্বাস। তারপর থেকে গোটা বিশ্বাস পরিবারটায় নেমে এসেছে এক আঁধার। বাবা সন্ন্যাসী, মা মমতা বিশ্বাস – কেউ এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না। তাঁদের শরীর খারাপ, তার চেয়েও বেশি খারাপ মন।
সেনাবাহিনীতে সুদীপের সাড়ে চার বছরের কর্মজীবনের মধ্যে তিন বছরই ভাইফোঁটা দিতে পারেননি ঝুম্পা। মন খারাপ হয়েছে, কিন্তু কাঁদেননি। পান, সুপারি, চন্দন কাপড়ে বেঁধে দরজায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। দাদা বাড়ি ফিরতেই সেসব হাতে তুলে দিয়ে, পালটা উপহার হিসেবে ভাল শাড়িও নিয়েছেন। নিজেও দাদাকে দিয়েছে জামা-প্যান্ট দিয়েছে। ঝুম্পা জানাচ্ছেন, গতবছর ভাইফোঁটাতেও দাদার জন্য জম্মু কাশ্মীরে দু’ হাজার টাকা তিনি পাঠিয়েছিলেন পোশাক কেনার জন্য। আর সুদীপ ভাইফোঁটার পর শেষবারের জন্য পৌষ মাসে বাড়িতে এসেছিলেন, তখনই বোনকে শাড়ি উপহার দেয়।
ঝুম্পার কাছে এখনও সব স্পষ্ট। এসব বলতে বলতে কেঁদে উঠছেন তিনি। বলেন, ‘ও যা যা খেতে ভালবাসত, তাই দিতাম। দাদা মাংস খেতেই বেশি ভালবাসত। ভাইফোঁটার দিন বিভিন্নরকম ফল, মিষ্টি, লুচি, তরকারি, সুজি, দই দিতাম। আমাদের পরের দিন আমিষ খাওয়া হত। সেদিন খাসির মাংস খাওয়াতাম দাদাকে।’ ঝুম্পা আরও বলছেন, ‘ফোঁটার দিন ও ফোন করত। বলত সরকারি চাকরি করি, কী করে আসি বল? একটা আশা ছিল পরের বছর ফোঁটা দেব। পুলওয়ামার পর সে সব নিভে গেল। আমি আর কাউকে ফোঁটা দেব না। নিজের দাদাকেই ধরে রাখতে পারিনি।’
কিন্তু বোনের এতদিনকার অভ্যেস, তা কি সহজ মুছে ফেলা যায়? ঝুম্পা তাই দাদার জন্য আজও সাজিয়েছেন থালা। দাদার ঘরে থাকা ছবির সামনে ফল, মিষ্টি সাজিয়ে ধূপ-প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। দাদার আত্মার শান্তিকামনায় প্রার্থনাও করেছেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.