নিজের বাড়িতে উকিল বর্মন। নিজস্ব চিত্র
বিক্রম রায়, শীতলকুচি: মাটির নিকোনো ‘শান্তি’র দাওয়ায় বসে সকালে দাড়ি কাটছিলেন। উদ্বেগহীন মুখে। কাল রাতে বেশ ঘুম হয়েছে। শান্তির ঘুম। সকালে দাওয়ায় পাশে বসে স্ত্রী। অদূরে খেলা করছে নাতি-নাতনিরা। কেমন লাগছে, প্রশ্নটার কোনও উত্তর নেই মুখে। স্রেফ প্রশান্তির হাসি। সেটাই সব কিছুর উত্তর। একগাল হাসি পাশে বসা উকিল বর্মনের স্ত্রীর মুখেও। উকিল বর্মন, সীমান্তে নিজের জমিতে চাষ করতে গিয়ে যাঁর ঠাঁই হয়েছিল বাংলাদেশের জেলে। একটাই আক্ষেপ, প্রায় একমাস কাটিয়ে নিজভূমে ফেরার পর, ‘‘সেদিন যখন চ্যাংদোলা করে দুষ্কৃতীরা তুলে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ রাইফেলসের জওয়ানদের হাতে তুলে দিল, তখন আমার চিৎকারে দেশের জওয়ানরা যদি এগিয়ে আসতেন, তাহলে..।’’
২৯ দিন প্রতি মুহূর্তে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভরে ছিল পশ্চিম শীতলকুচির বাসিন্দা উকিল বর্মনের জীবন। একইভাবে উদ্বিগ্ন ছিল তাঁর পরিবারও। ওপার বাংলাদেশের জেলে তাঁর মানসিক নির্যাতন কম হয়নি। বাংলাদেশ পুলিশ থেকে শুরু করে সঙ্গে থাকা একাংশ বন্দিদের দাবি ছিল, আর কোনওদিন বাড়ি ফিরতে পারবেন না উকিল। স্বাভাবিকভাবে মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলেন। জেলবন্দি অবস্থায় প্রতিদিন কার্যত ডুকরে কাঁদতেন, তবে শোনার মতো কেউ ছিল না। তবে কেন এই ধরনের পরিস্থিতি হল? নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিএসএফ কর্মীরা কেন তাঁকে বাঁচাতে পারলেন না? এখন এই প্রশ্নই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে উকিল বর্মন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মনে। তাঁদের দাবি, বিএসএফ সঠিকভাবে নজরদারি চালালে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হত না।
বিএসএফের প্রতি কিছুটা অভিমান করেই উকিল বর্মন বলেন, ‘‘কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে চার বিঘে জমি রয়েছে আমার। সেখানে চাষাবাদ করেই সংসার চলে। কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে যাওয়ার জন্য রীতিমতো বিএসএফের ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া কার্ড জমা রেখে তারপর যেতে হয়। ফিরতে দেরি হলে বা সমস্যা হলে বিএসএফের পক্ষ থেকে বাঁশি দিয়ে জানান দেওয়া হয়। অথচ ১৬ এপ্রিলের দুপুরে তেমন কিছুই হয়নি। চাষের জমিতে কাজ করার পর নিজের জমিতে সেচের জন্য নিয়ে যাওয়া পাম্প তিনি বিএসএফের গেটের কাছে রেখেছিলেন। ফের পাম্পের পাইপ-সহ অন্যান্য জিনিস আনতে গিয়েছিলেন। সেসময় হঠাৎ চারজন দুষ্কৃতী এসে তাঁকে চ্যাংদোলা করে বাংলাদেশে নিয়ে চলে যায়। তাঁকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেসময় তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করেছেন। অভিযোগ, বিএসএফ গেট খুলে এগিয়ে আসেনি। বিএসএফ যদি সেসময় ব্যবস্থা নিত, তাহলে ২৯ দিন বাংলাদেশের জেলে আর কাটাতে হত না।
সেদিন জমিতে কাজ করার সময় সঙ্গী ছিলেন উকিল বর্মনের স্ত্রী শৈব্যাবালা বর্মন। তিনিও বিএসএফের প্রতি একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “কিছুটা দূরেই সেদিন এক বাংলাদেশিকে বিএসএফ গুলি করেছিল। তারপর থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অথচ সেই বিষয়ে বিএসএফ জমিতে কাজ করা কৃষকদের কিছু জানায়নি। সতর্ক করা হয়নি। উল্টো গেটে তালা মেরে রেখে দিয়েছিল।” যখন তাঁর স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তিনি বিএসএফকে বলেছিলেন। অভিযোগ, বিএসএফ দায় এড়িয়ে ক্যাম্পে গিয়ে অভিযোগ করতে বলেছিল।
শুধু উকিল বর্মন নয়, ওই এলাকার অন্তত ৫০টি পরিবারের জমি রয়েছে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে। তাঁদের সকলের একই প্রশ্ন, জমিতে কাজ করতে যাওয়ার জন্য কার্ড বিএসএফের কাছে জমা দিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে কেন বিএসএফ সেখানে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে? গোটা ঘটনায় তাঁরা আতঙ্কে রয়েছেন। যদিও এই বিষয়ে বিএসএফের আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে গাফিলতির অভিযোগ বিএসএফের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.