দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: একসময় মিথ্যে কেসে একবার নয়, একাধিকবার জেল খেটেছিলেন। আজ তিনি একাধারে লেখক তথা দলিত সম্প্রদায়ের মুখ শুধু নন, গোটা বলাগড়ের মুখ। তিনি আর কেউ নন, লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। একসময় জেল খাটা দলিত এই রিক্সাচালকই এবারের বিধানসভা ভোটে বলাগড় কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের (Trinamool Congress) প্রার্থী। তিনি প্রার্থী হওয়ায় খুশি বলাগড়ের মানুষও।
নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, জেলে থেকে জীবনের নতুন উপলব্ধি হয়েছিল। তিনি জানান, বাংলাদেশের বরিশাল থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসে যাদবপুরে ওঠেন। অকপটে স্বীকারও করেন ছোটবেলায় একদিকে রিক্সা চালাতেন, মদ খেতেন, আবার মারামারিও করতেন। আবার বোনকে চোখের সামনে না খেতে পেয়ে মরে যেতেও দেখেছেন। যার দুঃখে আজও ভুলতে পারেননি। দিনে রিক্সা চালিয়ে, গরু ছাগল চড়িয়ে কোনোমতে কেটে যেত। রাতে তখন ষ্টেশনে শুতে হত। আর আরপিএফ তাঁকে কেসও দিত। চাকরি বাঁচাতে অনেক সময়ই মিথ্যে কেস দিয়ে জেলেও পাঠাত। একবার তো তাঁকে বলা হয়েছিল, বড় কেস দেওয়া হবে, দশ বছরের জেল হবে। শোনার পর থেকেই ভীষণ দুঃশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়াতে থাকে। কিন্তু জেলে যাওয়ার পরই নতুন উপলব্ধি হল। সেখানে এক প্রতারকের সঙ্গে পরিচয় হয় মনোরঞ্জন ব্যাপারীর। প্রতারকদের বুদ্ধি আর দশটা সাধারণ মানুষের থেকে বেশি থাকে। সেই তাঁকে বলে, জেলে কি করবি। লেখাপড়া জানতেন না। তাই কাঠের স্টিক এনে জেলের মেঝেতে ‘অ আা’ লিখে তার উপর দিয়ে কাঠের স্টিক বুলিয়ে বর্ণ পরিচয় শুরু। ধীরে ধীরে যুক্তাক্ষর শেখা, তারপর বই পড়া শুরু করেন। জেল থেকে বেরিয়ে একদিকে রিক্সা চালানো, অন্যদিকে বই পড়ার মধ্যে দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সাহিত্যের ভক্ত। শুধুমাত্র দুই মুঠো অন্নের যোগাড় করতে গিয়ে তাঁর শৈশব হারিয়ে গিয়েছিল। তাই এক শ্রেনীর পুঁজিপাতির দল সবসময় নিরন্ন মানুষগুলোকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে দেখে তিনি প্রতিবাদে কলম তুলে নিয়েছিলেন।
তাঁর লেখার শুরুটাও হয়েছিল অভাবনীয়ভাবে। ১৯৮১ সালে একদিন তাঁর রিক্সায় চড়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর মনে তখন বইয়ের একটি শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘জিজীবিষা’ শব্দের অর্থ কি? তখনও তিনি জানতেন না, তাঁর রিক্সায় বসে রয়েছেন মহাশ্বেতা দেবী। তাঁকে প্রশ্ন করে বসলেন, ”দিদি জিজীবিষা মানে কি?” মহাশ্বেতা দেবী তো রিক্সাচালকের মুখে এই প্রশ্ন শুনে অবাক। কথায় কথায় তাঁর জীবনসংগ্রামের কাহিনী শোনার পর তাঁকে বললেন, “তুমি আমার পত্রিকায় লিখবে।” এরপরই মহাশ্বেতা দেবীর পত্রিকায় লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের দলিত জীবন ও দলিত সম্প্রদায়ের অন্যান্যদের জীবন যন্ত্রণার কাহিনী তাঁর লেখনীতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ‘জিজীবিষার গল্প’ থেকে শুরু করে ‘বৃত্তের শেষ পর্ব’, ‘ইতিবৃত্তে চন্ডাল জীবন’-সহ তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা এখন ২১।
তাই এবার রাজনীতির ময়দানে পা রেখে অভাবী অত্যাচারিত, বঞ্চিত মানুষদের হয়ে কথা বলার জন্য বলাগড়ে প্রার্থী হয়েছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। বলাগড়ের দাপুটে তৃণমূল নেতা শ্যামাপ্রসাদ রায় বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মনোরঞ্জনদা প্রার্থী হওয়ায় খুশি আপামর বলাগড়বাসী। প্রত্যেকটা মানুষের অন্তরে তিনি রয়েছেন। তাই এই আসনে তাঁর জয় নিশ্চিত করবে বলাগড়ের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ। শনিবার মনোরঞ্জনবাবুর উপস্থিত না থাকলেও তার সমর্থনে বলাগড়ের মহীপালপুরে এক বিশাল মিছিল বের হয়। সাধারণ মানুষের বক্তব্য এতদিনে তাঁদের কাছের মানুষকে তাঁরা পেয়েছেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.