ভারতের সেনা মুখপাত্র কর্নেল সোফিয়া কুরেশির পরিবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের আহমেদ শরিফ চৌধুরীর বাবা সুলতান বসিরউদ্দিন মাহমুদ হতে পারেন পরমাণু বিজ্ঞানী, কিন্তু রাষ্ট্রসংঘের ‘সন্ত্রাসবাদী তালিকাভুক্ত’! এবারের ভারত-পাক লড়াই তাই ধর্মের লড়াই ছিল না। ছিল একটি ‘সভ্য’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের সঙ্গে ‘জিহাদি’ মনোভাবাপন্ন দেশের লড়াই। লিখছেন সুমন ভট্টাচার্য।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হোক, বা বহু প্রতীক্ষিত ফোনের সুবাদেই হোক, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর– আমাদের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশের সেনা মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর মনে যে-অনুভূতি ক্রীড়া করছে– তা হয়তো একটি বিখ্যাত বাংলা কবিতা দিয়ে তুলে ধরা যায়– ‘দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!/ স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো/ জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ।’
জয় গোস্বামীর এই ‘আইকনিক’ কবিতা, যাকে বাঙালির হৃদয়ে আরও বেশি গেঁথে দিয়েছে লোপামুদ্রা মিত্রর গান, সেটা মনে করানোর কারণ, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের আবহে দুই দেশের দুই সেনা মুখপাত্র– ভারতের কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর পরস্পরের বিপরীত অবস্থানে দঁাড়িয়ে থাকা চরিত্র।
কর্নেল সোফিয়া কুরেশির পরিবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। তঁার পূর্বপুরুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানের আহমেদ শরিফ চৌধুরীর বাবা সুলতান বসিরউদ্দিন মাহমুদ রাষ্ট্র সংঘর ‘সন্ত্রাসবাদী তালিকাভুক্ত’! অথচ সুলতান বসিরউদ্দিন মাহমুদ পাকিস্তানের একজন পরমাণু বিজ্ঞানী, কথিত আল-কায়দার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুলতান বসিরউদ্দিন মাহমুদ ২০০১ সালের অাগস্ট মাসে আফগানিস্তানের কান্দাহারে ওসামা বিন লাদেন এবং আমান-আল-জাহিরি, আল-কায়দার দুই শীর্ষ নেতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মার্কিন সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, সুলতান বসিরউদ্দিন মাহমুদের কাছ থেকে ওসামা বিন লাদেন পরমাণু বোমা পেতে মরিয়া ছিলেন।
কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী তাই দু’টি ভিন্ন জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতীক। শনিবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে পর্যন্ত, ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে, সাংবাদিক সম্মেলন করার সময় কর্নেল সোফিয়া কুরেশি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন– আমাদের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ নিরীহ নাগরিকদের ‘নিশানা’ করছে। মানব-ঢাল ব্যবহার করছে বঁাচতে। অন্যদিকে, আহমেদ শরিফ চৌধুরী সেই পাক সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, যঁারা পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছিল। ইতিহাসের সমাপতনে হলিউডের ‘কাল্ট ক্লাসিক’ জন ট্রাভোল্টা আর নিকোলাস কেজ অভিনীত ‘ফেস অফ’ সিনেমার মতো সোফিয়া কুরেশি আর আহমেদ শরিফ চৌধুরী ভাবমূর্তিকে পাশাপাশি রাখলে– সত্যিই প্রমাণ হয়ে যায়– ভারত এবং পাকিস্তান– দুই সহোদর প্রতিবেশী– কেন এবং কীসের জন্য আসলে লড়ছিল?
সোফিয়া কুরেশির শ্বশুরমশাই, কর্নাটকের গৌস সাব বাগেওয়াড়ি যেমন স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন– পুত্রবধূ কর্নাটকে শ্বশুরবাড়িতে এলে দেশি মুরগির ঝোল আর রুটি খেতে ভালবাসেন। আর, আমেরিকায় আল-কায়দার টুইন টাওয়ারে হামলার পর গ্রেফতার হয়ে যাওয়া সুলতান বসিরউদ্দিন মহম্মদ এখন ছাড়া পেয়েছেন বটে, কিন্তু পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে তঁাকে এমন একটি গোপন আস্তানায় থাকতে হয়, যার ঠিকানা কারও জানা নেই। সগর্বে তঁাকে নিয়ে মুখ খোলার লোক পাকিস্তানে বিরল।
কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী– এই উপমহাদেশের দু’টি মুসলিম চরিত্র আসলে বলে দেয়– ভারত ও পাকিস্তানের এই সংঘাত ধর্মীয় লড়াই ছিল না। বরং ছিল একটি ‘সভ্য’ দেশ ও গান্ধী-নেহরু-আজাদের তৈরি করে যাওয়া গণতন্ত্রর সঙ্গে জিন্নার ‘জিহাদি’ পাকিস্তানের লড়াই। ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ আর পাকিস্তানের ‘অপারেশন বুনিয়ান-আন-মারসুস’ কখনওই দু’টি ভিন্ন ধর্মের লড়াই ছিল না। তা ছিল দুই ধরনের মনস্তত্ত্ব ও সংস্কৃতির বিরোধ।
সোফিয়া কুরেশির দাদু সেনাবাহিনীতে ইসলাম ধর্মেরই শিক্ষক ছিলেন, আর আহমেদ শরিফ চৌধুরীর বাবা সুলতান বসিরউদ্দিন মহম্মদ ৯/১১ অর্থাৎ ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার আগেই বলেছিলেন– আসলে লিখেছিলেন– ২০০০ সালের পরে পৃথিবীতে সন্ত্রাসই রাজত্ব করবে! তার জন্য কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গেলে ক্ষতি নেই। সেই কারণেই, শনিবার সাংবাদিক সম্মেলনে, ভারতীয় বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্ত্রি পাক সেনাবাহিনী মুখপাত্রের আল-কায়দা যোগাযোগ এবং বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও ‘জঙ্গি নেটওয়ার্ক’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো ভারতের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অবস্থানই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাধ্য করল ফোন ঘোরাতে।
কর্নেল সোফিয়া কুরেশি আর তঁার স্বামী কর্নেল তাজউদ্দিন বাগেওয়াড়ির কিশোর পুত্র পরিবারের ঐতিহ্য মেনে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায়। মা ১৪০ কোটি মানুষের দেশের হয়ে রোজ সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, তা দেখেই সোফিয়া কুরেশির কিশোরী কন্যাও উর্দি গায়ে চাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। অন্যদিকে ইতিহাস বলে, সুলতান বসিরউদ্দিন মাহমুদ অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরে জন্মালেও তঁার পরিবার পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমার নানাশ্বশুর, সৈয়দ সিরাজ আলি, যিনি দেশভাগের সময় বর্ধমান থেকে ‘এক ট্রেন লোক’ জুটিয়ে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের বক্তৃতা শুনতে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন ও জামা মসজিদে দঁাড়িয়ে মৌলানার সেই ‘আইকনিক’ বক্তৃতা শুনে পূর্ব পাকিস্তানের জমিজমা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন– তিনি আজীবন বলতেন, ওই সময়টাই এই উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য ‘নির্ণায়ক মুহূর্ত’ ছিল। পারিবারিক ইতিহাস থেকে বুঝি, সেই সময় নিশ্চয়ই কর্নেল সোফিয়া কুরেশির পরিবার আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর পরিবারের যাত্রাপথ আলাদা হয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট ব্যক্তিগত তথ্য এখানে সংযোজন করে রাখতে চাই। আমার নিজের দাদু, হিন্দু ব্রাহ্মণ রূপে চিরকাল বাড়িতে লুঙ্গি পরেছেন। আর, নানাশ্বশুর ধুতি। ‘পোশাক’ ও ‘পদবি’ দিয়ে তাই ভারতে কিছুই নির্ধারিত হয় না, ২০২৫ সালের মে তা আরও একবার প্রমাণ করে দিয়ে গেল।
‘অপারেশন সিঁদুর’ আর এই অভিযানের দুই সেনা মুখপাত্র, কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডর বে্যামিকা সিং আদপেই রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতাকে বারবার মনে করিয়েছে। ‘হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য/ হেথায় দ্রাবিড়, চীন–/ শক-হুন-দল পাঠান-মোগল/ এক দেহে হল লীন।’ আমাদের জেনে রাখা ভাল– এঁদের দু’জনেরই স্বামী ভারতীয় সেনাবাহিনীতেই রয়েছেন। উইং কমান্ডর বে্যামিকা সিংয়ের স্বামী দীনেশ সাবারওয়াল হরিয়ানার ভিওয়ানি জেলার বাকোরা গ্রামের ছেলে। সোফিয়াকে নিয়ে কর্নাটকের শ্বশুরবাড়িতে যত উচ্ছ্বাস, বাকোরা গ্রামেও ‘বহু’-কে নিয়ে তেমন আবেগ। হরিয়ানা আর কর্নাটক– ভারতের উত্তর এবং দক্ষিণ প্রান্তের এই উচ্ছ্বাস ভারতের আত্মাকে মনে
করায়। আর, আগেই বলেছি, গুজরাতের মেয়ে, বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্রী সোফিয়া কর্নাটকে শ্বশুরবাড়িতে গেলে কী-কী চিকেন ডিশ খেতে ভালবাসেন, তা যখন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গর্ব করে ক্যামেরার সামনে বলেন– তখন বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, যিনিও একজন মহিলা, একটা কথা মনে খুব পড়ে যায়– ‘ভারতে যে যা খুশি পরবে, যা খুশি খাবে’।
সামরিক পরিভাষায় ‘ট্র্যাডিশনাল ওয়ার ফেয়ার’ বা সাধারণ যুদ্ধাস্ত্রে যখন পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিল না, রোজ একটু-একটু করে বড় ক্ষতির দিকে এগচ্ছিল, তখন সেই দেশের সেনামুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর বাবা সুলতান বসিরউদ্দিন মহম্মদের দর্শন অনুযায়ী– পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটি পরমাণু যুদ্ধের যে-হুমকি দিচ্ছিল, তা অস্বাভাবিক নয়। সুলতান বসিরউদ্দিন মহম্মদ ধ্বংসের বিউগল-ই চিরকাল বাজানোর কথা বলেছেন। এর বিপরীতে সোফিয়া কুরেশির পরিবারের গল্পে আবার ফিরে যাই। তঁার ভাই সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন– ‘নানাজি তো আমাদের ইসলাম শিক্ষাই দিয়ে গিয়েছেন, যে ইসলাম শান্তির কথা বলে, আক্রান্ত হলে জন্মভূমিকে রক্ষা করতে শেখায়।’
লড়াইটা তাই ছিল আদর্শের, জীবনদর্শনের। নিছক নয়াদিল্লি বনাম ইসলামাবাদে তা সীমাবদ্ধ ছিল না।
দুর্ভাগ্য, ২০২৫ সালেও আমাদের মহম্মদ আলি জিন্নার ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’-র মোকাবিলা করতে হল। এবং বিশ্ব আবারও পাকিস্তানকে চিনল।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
suman09bhattacharyya@gmail.com
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.