ফাইল ছবি
দেশের শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বে প্রশ্ন উঠে এসেছে, রাজ্যপালের পদগুলির কি আদৌ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? যদি একান্তই রাজ্যপালদের রাখতে হয়, তাহলে তাঁদের রাজ্যবাসীর কাছে দায়বদ্ধও থাকতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে কী হবে? কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
চিন-আমেরিকা শুল্কযুদ্ধের মতো একটি পরিস্থিতি হতে চলেছে সুপ্রিম কোর্ট ও দেশের সরকার পক্ষের একাংশের লড়াইয়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন চিনা পণ্যের উপর শুল্ক বাড়িয়েই চলেছেন এবং চিন যেমন পাল্টা পদক্ষেপ করেই চলেছে– তেমনই সুপ্রিম কোর্ট ও শাসক পক্ষ পরস্পরের প্রতি তোপ দেগেই চলেছে। শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের এই দ্বন্দ্ব সাম্প্রতিকে দেখা যায়নি। এই দ্বন্দ্ব ছায়া ফেলতে শুরু করেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও।
দেশের হবু প্রধান বিচারপতি একটি সংবেদনশীল এলাকায় বাহিনী রাখা হবে কি হবে না, সেই সংক্রান্ত মামলায় কিছুটা শ্লেষের সঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘এই বিষয়ে আমরা কিছু বললেই প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠবে!’ উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়ের পর বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এবং দীনেশ শর্মা যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন, তাতে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন বিজেপি সভাপতি জে. পি. নাড্ডা। দল বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না বলে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন নাড্ডা। সাংসদরা তাঁদের ব্যক্তিগত মত জানিয়েছেন বলে তাঁর দাবি। কিন্তু ধনকড়ের পরেই একই সুরে নিশিকান্ত দুবে ও দীনেশ শর্মার মন্তব্য থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, দলের অঙ্গুলিহেলনেই তাঁরা মুখ খুলেছেন।
গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবেকে হামেশাই বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে মন্তব্য করতে দেখা যায়। দলের নির্দেশেই যে তিনি সেই কাজ করে থাকেন তা নিয়ে বোধহয় বিতর্ক না করাই ভালো। তাঁর কাজ অনেকটা ‘ট্র্যাক টু’ কূটনীতির মতো। বিভিন্ন ইস্যুতে দলের মনোভাবটা তিনি প্রকাশ করে দেন। যদিও প্রকাশ্যে দল তাঁর মন্তব্য থেকে একটা লোক দেখানো দূরত্ব রক্ষা করে। সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে ধনকড় বা দুবের রোষের কারণ কী? তা হল, শীর্ষ আদালত রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালকে সংবিধানের ধারা স্মরণ করিয়ে এই নির্দেশ দিয়েছে যে তাঁরা আইনসভায় পাস হয়ে যাওয়া বিল অনন্ত কাল ফেলে রাখতে পারেন না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জমানায় গত ১১ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী-শাসিত রাজ্যে রাজভবনগুলোকে যেভাবে ব্যবহার করছে, তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। পদে পদে রাজ্যপালরা নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে সংঘাতে যাচ্ছেন। বিশেষত, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যপালদের হস্তক্ষেপ নজিরবিহীন। তামিলনাড়ু, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা ইত্যাদি রাজ্যে রাজ্যপালরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যেভাবে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছেন, তাতে ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’-এর (ইউজিসি) আইন সংশোধনের দাবি উঠে গিয়েছে। ইউজিসি-র আইনে উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রের নাক গলানোর নানারকম সুযোগ করে দেওয়া আছে। রাজ্যপালরা অধিকাংশ রাজ্যে ক্ষমতাবলে রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য। তাঁরা সেই পদকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কবজা করছেন। ইউজিসি-র আইনকে কাজে লাগাচ্ছেন।
ট্রাম্প আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেওয়ায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কার্যত মার্কিন সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বাধিকার তঁাদের কাছে অনেক বড় বিষয় বলে হার্ভার্ডের অাচার্য ঘোষণা করেছেন। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্ত তুলে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নটি সামনে আসছে। সেই প্রসঙ্গে এসে পড়ছে কেন্দ্রের মনোনীত রাজ্যপালদের ভূমিকাও। বিজেপি-বিরোধী দলগুলির হাতে থাকা রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালরা আরও যে-কাজটি করছেন তা হল– বিধানসভায় পাস হয়ে যাওয়া বিলগুলি আটকে রাখা। তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল এরকমই দশটি বিল আটকে রেখেছিলেন।
বাংলার রাজ্যপালও অন্তত আটটি বিল একইভাবে অাটকে রেখেছেন। এর মধ্যে একটি বিলে রাজ্যপালকে পদাধিকার বলে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া কথা বলা আছে। একই ঘটনা ঘটছে কেরলেও। সুপ্রিম কোর্ট তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আর. এন. রবির দশটি বিল আটকে রাখার সিদ্ধান্তকে বেআইনি ঘোষণা করে সংবিধানের ১৪২ ধারা প্রয়োগ করে বিশেষ ক্ষমতা বলে ওই দশটি বিল আইনে পরিণত করে দিয়েছে। এতেই বিজেপির মাথা গিয়েছে ঘুরে। সুপ্রিম কোর্টের ১৪২ ধারা প্রয়োগ করা থেকে বিজেপি বুঝতে পেরেছে– রাজ্যপালের যা খুশি করার দিন অর্থাৎ বিলে ‘পকেট ভেটো’ দেওয়ার দিন শেষ। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ তার ঐতিহাসিক রায়ে বলেছে– ‘সংবিধানের ২০০ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে রাজ্যপালকে বিধানসভায় পাস হয়ে যাওয়া কোনও বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিয়ে চলতে হবে।’
বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজভবনকে ব্যবহার করে হস্তক্ষেপ একসময় ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর জমানায় দেখা গিয়েছে। যখনই কেন্দ্রের শাসক দল তার রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, তখনই প্রবলভাবে রাজভবনকে ব্যবহার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, যখন কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে বিরোধীশাসিত কোনও রাজ্যের শাসক দলের রাজনৈতিক মতাদর্শগত দূরত্ব বেশি থেকেছে তখন রাজভবনের সক্রিয়তা বেশি দেখা গিয়েছে। রাজভবন তখন কেন্দ্রের শাসক দলের রাজনৈতিক দপ্তরে পরিণত হয়েছে। ধনকড় যখন বাংলার রাজ্যপাল ছিলেন, তখন তৃণমূলেরই অভিযোগ ছিল যে বিজেপির রাজ্য দপ্তর মুরলীধর সেন লেন থেকে উঠে রাজভবনে চলে এসেছে। বর্তমান সময়েও সেই ধারাবাহিকতা কম-বেশি রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে ধনকড়ের প্রতিক্রিয়া তাই স্বাভাবিকভাবেই বোধগম্য।
সুপ্রিম কোর্টের রায় শুধু সংবিধানের আদর্শই নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল দর্শনকেও তুলে ধরেছে। গণতন্ত্রে নির্বাচিত সরকারের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছে। সঙ্গে-সঙ্গে এই প্রশ্নকেও সামনে এনেছে যে, রাজ্যপালের পদগুলির কি আদৌ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? যদি একান্তই রাজ্যপালদের রাখতে হয়, তাহলে তাঁদেরও রাজ্যবাসীর কাছে দায়বদ্ধ থাকার ব্যবস্থা তৈরির দাবিও প্রচ্ছন্নভাবে তুলেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে কী হবে? রাষ্ট্রপতি পরোক্ষে নির্বাচিত। সুপ্রিম কোর্ট কি রাষ্ট্রপতির ভূমিকাতেও প্রশ্ন তুলতে পারে? এই বিতর্কটি কিন্তু চট করে থামবে না। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য সত্যি-সত্যিই ট্রাম্পের আচরণের মতোই ‘ডিসরাপটিভ’। এই দ্বন্দ্ব কীভাবে নিরসন হয় এখন সেটাই দেখার। সুপ্রিম কোর্ট কি পিছু হঠবে? যার ইঙ্গিত কেউ-কেউ হবু প্রধান বিচারপতির মন্তব্যে পাচ্ছেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.