নির্মল ধর: সালটা সম্ভবত ১৯৯৩ হবে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta) তাঁর নতুন ছবি ‘চরাচর’ এর (Charachar) শুটিং দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের (North Bengal) পাখিরালয়ে। ছবির গল্পই পাখিধরাদের নিয়ে, সুতরাং সেই রকম একটা লোকেশন
দরকার ছিল। প্রকাণ্ড ঝিলও ছিল কাছেই। পাখিদের আনাগোনা তো আর শুটিংয়ের সুবিধে-অসুবিধে ভেবে হয় না, হচ্ছিলও না। অপেক্ষা আর অপেক্ষা! সারাদিন কাটানোর পর হঠাৎ পাখিদের দেখা মিলল ঝিলের অন্য প্রান্তে। গাড়ি নিয়ে ক্যামেরাম্যান-সহ বুদ্ধদেববাবু ছুটলেন ঝিলের সেই দিকটাতে। আর আমদের ফটোগ্রাফাররা কোনওমতে একটা ডিঙি জোগাড় করে ভেসে পড়েছিলেন ঝিলের মাঝে। তাঁদের তো ছবি তোলার ছবি তুলতে হবে! খুবই তাড়াহুড়ো! হাতে সময়ও কম। আমরাও পড়িমরি করে পাড় ধরে শুটিং স্পটে।
অভিনেতা রজিত কাপুর (Rajit Kapoor), সাধু মেহেরকে (Sadhu Meher) নিয়ে গোটা তিন শট নেওয়া হল। সূর্যদেব তখন অস্তাচলে। আমরাও ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফটোগ্রাফারদের ডিঙি তখনও ঝিলের মাঝখানে। হঠাৎ এক ঝোড়ো হাওয়া এসে নিমেষের মধ্যে ডিঙি দিল উলটে। ক্যামেরা সমেত দু’জন ফটোগ্রাফার জলে পড়ে গেলেন। এদিকে শট নিয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তরা ততক্ষণে ক্যাম্পের দিকে প্রায় চলে গিয়েছিলেন। তখনও মোবাইল আসেনি হাতে হাতে। তবে চিৎকার শুনেই আবার সকলে ফিরে আসেন। শুটিং তখন মাথায় ওঠে বুদ্ধবাবুর। নিজে দাঁড়িয়ে তদারকি করে দু’টো ডিঙি জোগাড় করেন। তা পাঠানো হয় ফটোগ্রাফারদের বাঁচাতে। অন্ধকারে কোনওমতে সকলকে ডাঙায় তুলে আনা হয়।
পরে ক্যাম্পে এসে উত্তেজিত বুদ্ধদেব বলেছিলেন, “শুটিংয়ের ছবি তোলার জন্য এমন ঝুঁকি নেওয়া মোটেই উচিত হয়নি। মারাত্মক কিছু হতেই পারত। এটাতো আর এক্সক্লুসিভ কোনো নিউজ নয়। কী দরকার!” উনি সেদিন না থাকলে কী যে হতো জানি না। সারাটা রাত দুই ফটোগ্রাফারের দিকে নজর রেখেছিলেন। ওষুধের ব্যবস্থা করেছিলেন। রাত জেগে তাঁদের শরীরের খবরাখবর নিয়েছিলেন। নির্দেশ দিয়েছিলেন পরদিন ওঁরা যেন শুটিংয়ে না যান। ছবির ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে দেবেন, করেওছিলেন।
ততদিনে জাতীয় পুরস্কারজয়ী ছবির পরিচালক তিনি। এসব দিকে নজর নাই দিতে পারতেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। দায়িত্বটা প্রোডাকশন বিভাগের ওপর ছেড়ে দিলেই চলত। কিন্তু তা তিনি করেননি। নিজে দাঁড়িয়ে সবার দেখভাল করেছিলেন। এটাই একজন মানাবিক মানুষের কাজ। ব্যক্তিগত ভাবে মানুষটি যদি সচেতন, সংবেদনশীল, মানবিক না হন, তাঁর পক্ষে মানুষের ভাল লাগার মতো ছবি বানানো সম্ভব নয়। সেটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের একডজন ছবির মধ্য দিয়ে বারবার প্রমাণ করে গেছেন। শুরু সেই ‘দূরত্ব’ থেকে, শেষ ছবি ‘উড়োজাহাজ’ পর্যন্ত তিনি সব ছবিতেই জীবনের জয়গান গেয়েছেন। অবশ্যই তাঁর নিজস্ব ভাষায়, ব্যাকরণে, ছন্দে, তালে। প্রযোজকের আঙ্গুলিহেলনে তিনি কখনও ক্যামেরার পেছনে দাঁড়াননি, চিত্রনাট্যও লেখেননি।
প্রতিবাদও করেছেন তাঁর নিজস্ব শর্তে, নিজের মতো করেই। ঝান্ডা নিয়ে মিছিল নয়, স্লোগান নয়, কবিতার মতো ছন্দময় লাইনেই উঠে আসত তাঁর প্রতিবাদ, একক প্রতিরোধ। বুদ্ধদেবের ছবির প্রধান গুণ ছিল ভিজ্যুয়াল। তাঁর ক্যামেরায় যেন উঠে আসত কবিতার এক একটি লাইন। তাঁর ফ্রেমিং প্রকাশ করত নাচের কোরিওগ্রাফির মতো ভঙ্গিমা। কখনও শিল্পীর ক্যানভাসের মতো অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়েও জীবনের আভাস পাওয়া যেত। বিষয় থেকে বিষয়ে চলাচল করেও তিনি কখনও সিনেমার নিজস্বতা থেকে এক মুহূর্ত সরে আসেননি।
‘বাঘ বাহাদুর’ ‘উত্তরা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘চরাচর’, ‘তাহাদের কথা’ থেকে হিন্দি ছবি ‘অন্ধি গলি’ ও ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’, কোথাও তিনি কবিতা এবং সিনেমার মেলবন্ধন ঘটানো থেকে চ্যুত হননি। সত্যিই বলতে তিনি ছিলেন বাঙালি পরিচালকদের মধ্যে সব চাইতে বেশি আন্তর্জাতিক। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের পরেই তাঁর নাম উচ্চারিত হত আন্তর্জাতিক উৎসবের আঙিনায়। জাতীয় পুরস্কারও তাঁর রেকর্ড। সত্যজিৎ রায়ের মতো তাঁরও পাঁচটি ছবি সেরা ভারতীয় ছবির স্বীকৃতি পেয়ে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক জিতেছে। যা এখনও পর্যন্ত কোনও পরিচালক পাননি।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি মানেই কবিতা ও সিনেমার এক সুষম মালা। তিনিই লিখতে পেরেছিলেন, “…মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ মরে যায় / কাহার তাতে ক্ষতি? কিই বা ক্ষতি হয়? / আমার শুধু বুকে গোপনে জ্বর বাড়ে / মানুষ বেঁচে থাকে মানুষ মরে যায়…”
– তাঁর এই অজানার দেশে চলে যাওয়াটা কারও কারও বুকে সত্যিই গোপনে জ্বর বাড়িয়ে গেল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.