সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে এনসিইআরটি-র মুঘল সাম্রাজ্যকে বাদ দেওয়ার ঘটনাটি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস, যার মাধ্যমে নীরবে ভবিষ্যতের নাগরিকদের মগজধোলাই চলছে। তবে যেহেতু সিবিএসই ছাড়া কোনও বোর্ডই এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে না, সেক্ষেত্রে তথ্যলোপ বা বিকৃতি ঘটিয়ে এনসিইআরটি কতটুকুই বা লাভ করবে রাষ্ট্রের? লিখছেন অংশুমান কর।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কাউন্সিল (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং/ এনসিইআরটি) সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে যে-পাঠ্যপুস্তকটি প্রকাশ করেছে তাতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে ইতিহাস, ভূগোল এবং সমাজ ও রাজনৈতিকভিত্তিক বিষয়গুলির জন্য তিনটি আলাদা বই থাকত। এখন বিষয়গুলির জন্য একটি একক পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়েছে, যার নাম: ‘এক্সপ্লোরিং সোসাইটি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিয়ন্ড’ (প্রথম খণ্ড)।
এনসিইআরটি-র এক বরিষ্ঠ আধিকারিক জানিয়েছেন, বইটির দ্বিতীয় খণ্ড আগামী কয়েক মাসের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম খণ্ডে রয়েছে শুধু সেসব বিষয়, যেগুলি শিক্ষাবর্ষের প্রথম ছ’-মাসে পড়ানো হবে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কারণ, সপ্তম শ্রেণির বইটিতে আগে বারো থেকে পনেরো শতকের দিল্লির সুলতান শাসন এবং ষোলো শতকে মুঘলদের উত্থান পড়ানো হত। নতুন বইতে এসবের উল্লেখমাত্র নেই। দ্বিতীয় খণ্ডেও থাকবে কি না সে-সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কাউন্সিল নীরব, বিশেষজ্ঞরাও সন্ধিহান।
সন্দেহটি অমূলক নয়। বিগত কয়েক বছর ধরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কাউন্সিল স্কুল শিক্ষার পাঠ্যক্রমে এমন সব পরিবর্তন এনে চলেছে যা নানাবিধ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যেমন, গত বছর এনসিইআরটি দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন এনে বলেছিল, সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাগুলি হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ হিসাবে বহিরাগত আর্যদের ভারতে আগমন তত্ত্বকে নস্যাৎ করেছে। অর্থাৎ, আর্যদের দেখতে হবে ভারতের আদিবাসিন্দা হিসাবেই। একইভাবে, ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে, এনসিইআরটি বীরসা মুন্ডার উপর একটি অধ্যায় থেকে ‘হিন্দু’ শব্দটি বাদ দিয়েছিল। আগের বইটিতে সেই অধ্যায়ে বলা হয়েছিল, বীরসা মুন্ডা মিশনারি ও হিন্দু জমিদারদের বিরোধিতা করতেন। বাক্যটি থেকে ‘হিন্দু’ শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়।
এ বছরই যেমন সপ্তম শ্রেণির নতুন বইটিতে অষ্টম অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্তিটি বিস্ময়কর। এই অধ্যায়ের শিরোনাম ‘হাও দ্য ল্যান্ড বিকামস সেক্রেড’ (ভূমিটি কীভাবে পবিত্র হল)। অধ্যায়টি ‘ভাগবত পুরাণ’-এর এক উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে এবং সমস্ত ধর্মের তীর্থস্থানের পবিত্রতা ও গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। এতে কুম্ভমেলার উপর একটি বিশেষ অংশও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, স্কুলশিক্ষার পাঠ্যবইয়ে ধর্মীয় স্থানের পবিত্রতা নিয়ে কোনও অধ্যায় আদৌ থাকা উচিত কি না।
বোঝাই যাচ্ছে যে, এসব পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে মূলত ইতিহাস বইগুলিতেই। অবশ্যই সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তা হল– ভারতের ইতিহাসের একটি খণ্ডচিত্র পড়ুয়াদের সামনে উপস্থিত করা। এটি হবে এমন এক চিত্র যেখানে শক-হুন দল, পাঠান-মোঘল একদেহে লীন হয়ে নির্মিত ভারতের থেকে আলাদা। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং বিরোধীদের প্রতিরোধের কারণে আমাদের দেশটিকে একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসাবে ঘোষণা করা শাসক দলের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। কাজেই স্কুলশিক্ষায়, বিশেষ করে ইতিহাসকে, এমনভাবে নির্মাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যাতে এ দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা মনে মনে একটি হিন্দু রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়ে ওঠে। এ আসলে যে কোনও শাসকের চিরকালীন অভীপ্সা। লুই আলথুসার সেই কতকাল আগেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, রাষ্ট্র যেসব ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস ব্যবহার করে থাকে, আধুনিক সময়ে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘অ্যাপারেটাস’ হল স্কুল। একটি স্কুলেই একটি শিশু দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায়। পাঠ্যপুস্তক তার কাছে ধ্রুবতারকার চেয়েও বেশি স্থির ও সত্য। আর শিক্ষক প্রায় ভগবান। রাষ্ট্র তাই স্কুলের মাধ্যমেই নীরবে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মগজধোলাইয়ের কাজটি করতে থাকে।
ভারতে সাম্প্রতিক অতীতে যেভাবে রাষ্ট্র এই কাজটি সম্পন্ন করতে চাইছে সে প্রসঙ্গে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই হয়। প্রথমত, ইতিহাসের নানাবিধ ব্যাখ্যা অবশ্যই হয়। ইতিহাস লেখার দৃষ্টিকোণ ঠিক করে দেয় কোন ইতিহাসকে পাঠকের সামনের পেশ করা হবে। কিন্তু কিছু সময়-প্রমাণিত তথ্যকে কখনও ইতিহাসের আঙিনার বাইরে রাখা যায় কি? যেমন, বীরসা মুন্ডা যে হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, এ তো তথ্য। এই তথ্য গোপন করা তো অপরাধ! একইভাবে ভারতের ইতিহাস রচনা করতে গেলে মুঘল যুগ পত্রপাঠ বাদ দিয়ে তা করা সম্ভব কি? স্কুল শিক্ষায় তথ্যের এহেন বিকৃতি এর আগে সত্যিই আর দেখা যায়নি।
দ্বিতীয় বিষয়টি আরও গুরুতর। এনসিইআরটি একটি স্বশাসিত কেন্দ্রীয় সংস্থা, যা কেন্দ্র এবং রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে পারে এবং নানা বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু শিক্ষা যেহেতু সংবিধানে যুগ্ম তালিকায় রয়েছে, তাই রাজ্য সরকারগুলি এই পরামর্শ গ্রহণে সবসময় বাধ্য নয়। যেমন, পশ্চিমবঙ্গেই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনে যে-ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলি আছে সেখানে এনসিইআরটি-র বইগুলি পড়ানো হয় না। ভারতের আরও অনেক রাজ্যেরই বাস্তবতা এটাই। উল্লেখ্য, এমনকী আইসিএসই বোর্ডও এনসিইআরটি-র বইগুলো পড়ায় না। সেই বইগুলো পড়ায় মূলত সিবিএসই বোর্ডই। এর ফলে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, স্কুল শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক নির্মাণ করতে গিয়ে এনসিইআরটি-র মাধ্যমে তথ্যলোপ বা তথ্যবিকৃতি ঘটিয়ে কতটুকু লাভ হবে রাষ্ট্রের? মাত্র এক অংশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মগজধোলাই করা যাবে। কাজেই এই চেষ্টা না-করাই ভাল নয় কি?
এ প্রসঙ্গে আরও একবার ফিরে যেতে হয় আলথুজারের কাছে। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রনির্মিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই এমন এক-দু’জন শিক্ষক থাকেন, যঁারা ছাত্রদের রাষ্ট্রনির্দেশিত পথে না পড়িয়ে, অন্যভাবে ভাবতে শেখান। অনেকেরই এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যেতে পারে, সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশ’-এর উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালাটির কথা। রাষ্ট্রের দমনপীড়ন সত্ত্বেও সেই সিনেমায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল উদয়ন পণ্ডিতেরই। একইভাবে, মনে রাখা দরকার, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোই ভারতের ইতিহাস এবং বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণাটির সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। এনসিইআরটি-কে ব্যবহার করে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মগজধোলাইয়ের চেষ্টা করছেন যঁারা, তঁাদের এটিও মনে রাখা উচিত যে, ইতিহাস কেবলমাত্র বইয়ের পাতাতেই লেখা থাকে না। ইতিহাস লেখা থাকে মানুষের সমষ্টিগত স্মৃতিতেও। ইচ্ছা করলেই সেই স্মৃতিকে মুছে ফেলা যায় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.