Advertisement
Advertisement
Jammu and Kashmir

মে মাসের অর্ধেক শেষ, ‘পর্যটক’ দেবতার সন্ধানে ভূস্বর্গ

আবার কবে ভয় জয় করে পর্যটকরা পা রাখবেন ভূস্বর্গে?

Jammu and Kashmir is suffering from lack of tourists
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:May 20, 2025 5:00 pm
  • Updated:May 20, 2025 5:00 pm  

মে মাসের অর্ধেক শেষ। ধু ধু করছে কাশ্মীর। মাছি মারছেন হোটেল ব্যবসায়ী, রেস্তোরাঁর মালিক, শিকারা-চালক, ক্যাব ড্রাইভার, হাউসবোটের কর্মী থেকে শুরু করে হালফিলে তৈরি হওয়া নতুন ‘পেশা’ রিলমেকারের দল। আবার কবে ভয় জয় করে পর্যটকরা পা রাখবেন ভূস্বর্গের আনাচকানাচে? সোমনাথ রায়

শ্রীনগরের রাজবাগ এলাকার বিখ্যাত জিরো ব্রিজ তখন শুনশান। গত বছর বিধানসভা নির্বাচন কভার করতে আসার সময়ও দেখেছিলাম– ব্রিজে ভিড় ‘জেন জি’-র। কেউ তুলছে সেলফি, কেউ বানাচ্ছে রিল, কেউ-বা আবার একান্তে একপলকে একটু দেখা করে নিচ্ছে। কেউ-কেউ ব্রিজে থাকা ফুড সেন্টারে রসনাতৃপ্তি করছে মনের আনন্দে। এখন সেখানে ‘নিল বাটে সান্নাটা’।

Advertisement

এই আবহেই ব্রেকফাস্ট করতে ঢুকেছিলাম একটি রোডসাইড রেস্তোরাঁয়। অর্ডার দিয়ে খাওয়ার অপেক্ষা করছি। মনে-মনে বলছি– জলদি দে রে ভাই। কেলারের এনকাউন্টার যে শেষ হয়ে এল! ঠিক সেই সময় দোকানে ঢুকলেন একজন। ফার্স্ট লুকেই যে কেউ বলে দেবে, তিনি কাশ্মীরি নন। অশক্ত শরীর। গায়ে জীর্ণ, অপরিষ্কার পোশাক। কঁাচুমাচু মুখে, পা গুনতে-গুনতে এগিয়ে গেলেন কাউন্টারে বসা ব্যক্তির দিকে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি নোট বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন– ‘ভাইজান, আমার কাছে এই দশটা টাকাই আছে। কিছু খেতে দিতে পারেন? খুব খিদে পেয়েছে।’

অবাক হয়ে আগন্তুকের দিকে তাকালেন কাউন্টারে বসা ভদ্রলোক। কয়েক সেকেন্ডের ‘পজ’ দিয়ে কাশ্মীরি সিগনেচার স্টাইলে স্মিত অথচ আন্তরিক হাসি মুখে এনে চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন অপরিচিত লোকটিকে। বললেন, ‘ভাইজান, এটা কাশ্মীর। এখানে কেউ খালি পেটে থাকে না।’ কিচেনের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলেন, ‘ইনকো নাস্তা খিলাও।’ না, ঘটনাটা দেখে এতটুকু অবাক হইনি।

গত ছ’-বছরে অগুনতিবার ভূস্বর্গে এসে কাশ্মীরিদের আতিথেয়তা নিয়ে সম্যক ধারণা অনেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। তাই মনে-মনে যখন ভাবছিলাম– লোকটার খাওয়ার খরচ না হয় আমিই দিয়ে দেব, তার আগেই ‘কাশ্মীরিয়ৎ’-এর পরিচয় দিয়ে দিলেন নাম-না-জানা সেই কাশ্মীরি ম্যানেজার। এঁদের মতো অতিথিপরায়ণ খুব কম মানুষই হয়। গত মার্চে ধসের কারণে সোনমার্গে আটকে পড়া পর্যটকদের নিজের ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিল কাশ্মীরিরা। গুরুদ্বারের লঙ্গরে পেট ভরিয়েছিল দেশের অন্যান্য প্রান্তের মানুষ।

হিন্দু পণ্ডিত, মুসলমান, শিখ, অথবা লেহ শহরের বৌদ্ধ। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের প্রতিটি মানুষের মনের গভীরতা যেন এক-একটি ডাল লেক, ঝিলম বা চেনাব। সবসময় মুখে থাকে হাসি। দোকানি হন বা ট্যাক্সি ড্রাইভার। আকছার বলতে শোনা যায়, ‘অসুবিধা হলে টাকা বাড়ি পৌঁছে দেবেন। সমস্যা নেই।’ আসলে, পর্যটন-নির্ভর মানুষগুলি জানে, পর্যটকরা তাদের লক্ষ্মী। তারা টাকা মেরে দেবে না। উল্টে খুশি মনে ফিরলে ভবিষ্যতে কাশ্মীরে আসা পরিচিতদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে; যাতে বাড়বে ব্যবসা।

শুধু কি পর্যটক? বেশ কয়েকবার এমনও হয়েছে, হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট ছাড়তে যাওয়ার সময় এই অধমকে ড্রাইভার সাবির ভাই গাড়ির বিলের হিসাব দেননি। জানতে চাইলে বলতেন, ‘আরে, তুমি আমার ভাই। বিল হোয়াটসঅ্যাপ করে দেব, পাঠিয়ে দিও। আগে ভালভাবে বাড়ি পৌঁছও।’ একইভাবে বন্ধু মাসুদ ভাই বা তঁার পরিবার, কাশ্মীরে থাকাকালীন, আকছার ফোন করে জানতে চান, ‘কোই চিজ কা জরুরত তো নেহি হ্যায়? পয়সা হ্যায় ইয়া কুছ ভেজু?’ না‌, টাকা দিয়ে এই আন্তরিকতার মূল্য বোঝা যায় না। হয়তো পর্যটন শিল্পে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, স্থানীয়দের পেটে যাতে লাথি না-পড়ে, সেই কারণে ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিলের আগে পর্যন্ত পর্যটকদের উপর সেভাবে কোনও আঘাতও হয়নি।

এটাও ঠিক যে, একাধিকবার অমরনাথ যাত্রীদের উপর নাশকতা ঘটিয়েছে ওপার থেকে আসা কিছু সন্ত্রাসবাদী। সে কারণেই শুধু পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদেরই নয়, টু‌্যরিস্ট, পুলিশকে পর্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলতে শুনেছি, এখানে পর্যটকদের কোনও চিন্তা নেই। তারা নিরাপদ। অথচ সপ্তাহ চারেক আগে পহেলগাঁওয়ের বৈসরণ উপত্যকায় হয়ে যাওয়া নাশকতার পর ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে।

ধু ধু করছে কাশ্মীর। মাছি মারছেন হোটেল ব্যবসায়ী, রেস্তোরাঁর মালিক, শিকারা-চালক, ক্যাব ড্রাইভার, হাউসবোটের কর্মী থেকে শুরু করে হালফিলে তৈরি হওয়া নতুন ‘পেশা’ রিলমেকারের দল– প্রত্যেকে। মে মাসের অর্ধেক শেষ। গরম থেকে বাঁচতে যে-পর্যটকরা একটু ফাঁকায়-ফাঁকায় ঘুরতে চান এই সময়টায়, তাঁরা সত্যিই কেমন ঘুরছেন? পহেলগাঁও থেকে ফেরার পথে আপেল উপত্যকায় দেখা হয়েছিল কলকাতা থেকে যাওয়া একজন পরিচিতর সঙ্গে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে একটু ফাঁকায় ঘুরবেন বলে বাচ্চাদের স্কুলে ছুটি পড়ার আগেই কাশ্মীর আসার পরিকল্পনা করেছিলেন মাস তিনেক আগে। আক্ষেপ করে বললেন, ‘এতটা ফঁাকাও চাইনি। বেশিরভাগ জায়গা তো দেখতেই পেলাম না! যে হোটেলেই উঠেছি, সেখানে আমরা ছাড়া কেউ নেই।’

দিন কয়েক বাদেই আবার স্কুলগুলিতে শুরু হয়ে যাবে গরমের ছুটি। তখন তো শ্রীনগরের চশমে শাহি, মুঘল গার্ডেন, নিশাদ গার্ডেন থেকে শুরু করে পহেলগঁাওয়ের বেতাব ভ্যালি, গুলমার্গ, সোনমার্গ হয়ে লেহ, লাদাখ– বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পা ফেলা দায় হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বেশিরভাগ হোটেলেই আগস্ট পর্যন্ত ঝুলে গিয়েছিল হাউসফুল বোর্ড। অথচ ২২ এপ্রিলের সেই কালো দিনের পর বাতিল হওয়া শুরু হয়েছে সব বুকিং। কীভাবে চলবে সংসার, কী হবে ভবিষ্যৎ? এই প্রশ্নে মাথা ঠুকছে স্থানীয়রা। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে যখন দেশ গর্বে ছাতি ফুলিয়ে ঘুরছে, তখন সিঁদুরে মেঘ দেখছে কাশ্মীর। আর তাই প্রত্যেকে চাইছে আবার ভূস্বর্গে পড়ুক ‘পর্যটক’ দেবতার পায়ের ছোঁয়া।

বৈসরণ নাশকতায় একমাত্র স্থানীয় শহিদের নাম সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। কাজের স্বার্থে বারদুয়েক যেতে হয়েছে তাঁর বাড়িতেও। প্রথমবার ছেলের হঠাৎ মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই থম মেরে ছিলেন বছর সত্তরের সৈয়দ হায়দার শাহ। দ্বিতীয়বার গিয়ে পরিচয় দিতে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে ঠিক চিনতে পারলেন। তিনিও বলছিলেন, ‘সরকার আপাতত ছোট ছেলেকে একটা অস্থায়ী চাকরি দিয়েছে। কিন্তু আদিলের মতো বাকিদের কী অবস্থা ভাবুন তো? সবার কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, ভয় পাবেন না। আপনারা আসুন। আল্লাহ না করুক, যদি ফের কোনও বিপদ হয়, তাহলে আরও অনেক আদিল এই কাশ্মীরের মাটিতে আছে আপনাদের রক্ষা করার জন্য।’

যখন এই কথাগুলি বলছিলেন তিনি, সুয্যিমামা ততক্ষণে ঘুমতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই গোধূলিবেলায় হায়দারের মুখে যেন পাওয়া গেল চেনা কেশর ফ্লেভারের কাশ্মীরি আতরের গন্ধ। যাতে মিশে আন্তরিকতা, কাশ্মীরি মাদকতা। বললেন, ‘এখন আর যেতে হবে না, রাতটা এই গরিবখানাতেই কাটিয়ে যান।’ এটাই কাশ্মীর।

শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এই এলাকা ভূস্বর্গের আখ্যা পায়নি। এখানের বাসিন্দাদের মনও দেবতুল্য। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই দেবতাদের উপর ভরসা, বিশ্বাস করতে পারছে না বেশিরভাগ মানুষ। তবে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে সদ্য পুত্র হারানো পিতা থেকে শুরু করে জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রত্যেকে তামাম দেশবাসীর কাছে এই আর্তিই করছেন– ভয় পাবেন না। আবার আসুন। আপনাদের পাশে আমরা আছি।
সন্ত্রাসের আতঙ্ক কাটিয়ে দেশবাসী কি সেই ডাকে সাড়ে দেবে? উত্তর দেবে সময়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement