বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ছুটছে গেদে লোকাল। পোয়াতিরা সব এক কামরায়। কাকতালীয়? সীমান্তের মা(Mothers of Soldiers) কখনও নিশ্চিন্ত থাকে না। সন্তান গুলি খেয়ে এদিক-সেদিকে পড়ে থাকে। খবর আসে। একই খবর ফিরে ফিরে আসে। লিখছেন মঞ্জীরা সাহা।
ট্রেনটা চলেছে ফাঁকা মাঠের মাঝখান দিয়ে। বেশ ভালো স্পিড তুলেছে। দু’পাশে দূরে দূরে আমগাছের সারি। তালগাছ। খেজুরগাছ। অন্ধকারে গাছগুলোকে যেন কেমন ভূতের মতো দেখাচ্ছে। একটু বেলা থাকতে জানালা দিয়ে ওদিকে তাকালে দেখা যেত গাছগুলোকে। অন্ধকারে হাওয়ায় গুঁড়ো গুঁড়ো কী একটা উড়ে এসে চোখে-মুখে পড়ছে। ওগুলো আমের মুকুল। মুকুলে মুকুলে গাছগুলো ভরে আছে। আর কিছুদিন পরেই টসটসে পাকা আম ধরবে গাছগুলোতে। এদিককার আম বিখ্যাত।
বেশ বড়সড় স্টেশনটা ছাড়িয়ে ট্রেনের বগিটা আরও ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। এরপরের হল্ট স্টেশনগুলো অন্ধকার। নির্জন। লাস্ট সিটগুলিতে বেশ কয়েকজন মেয়ে জড়সড় হয়ে বসা। কেউ ২২-২৩, কেউ ৩০-৩২, কেউ ৪৫-৫০ হবে। আর কেউ নেই। একটামাত্র আলো জ্বলছে বগিটার ভেতরে। টিউবের উপর দিয়ে ঝুল পড়ে আলোটা আবছা আবছা লাগছে। হালকা দেখা যাচ্ছে মেয়েদের শরীরগুলো। পেটগুলো ফোলা ফোলা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ফোলাই তো! ঠিক যেন আট ন’মাসের পোয়াতি। একজন দু’জন তিনজন…। এ কী! এক কামরায় সব মেয়ে পোয়াতি? ট্রেনটা দুলছে। ইছামতি ক্রস করছে এবার।
এরা কারা? ট্রেনটা যাচ্ছে কোথায়? ট্রেনটা যাচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। এটা গেদে লোকাল। ওই যে অল্প বয়সি বেশি বয়সি পোয়াতি মেয়েরা বসে আছে, ওরা কেউ ‘পোয়াতি’ নয়। ওদের পেটে ডজন ডজন ফেন্সিডিল ভর্তি কাচের শিশি বাঁধা। শিশিগুলিতে ভরা কালো কালো নেশার ওষুধগুলো নড়ে নড়ে উঠছে ট্রেনের দুলুনিতে। ওরা চলেছে বর্ডারের দিকে ওই ফেন্সিডিলের শিশিগুলি ডেলিভারি দিতে। রাতের অন্ধকারে শেওড়া, ঢোলকমি, কচু গাছের জঙ্গলের ভিতর গিয়ে ওই মোটা মোটা পেট নিয়ে বসে থাকবে। লোক আসবে ওখানে। তারা নিয়ে যাবে এসে শিশিগুলি। বস্তায় ভরে ছুড়ে মারবে কাঁটাতারের ওপারে। ডজন হিসেবে দেড়শো কি দুশো টাকা পাবে মেয়েরা। পান্তাভাত, দুটো বাসি রুটি খেয়ে ওরা সেই ভোর চারটে নাগাদ বেরোয় বাড়ি থেকে। তারপর একবার ডাউনে একবার আপে। শাড়ি খুলে সায়ার উপর পেট ভর্তি করে দু’ডজন তিনডজন নেশার ওষুধের শিশি দড়ি দিয়ে কষে বাঁধে ট্রেনের ভেতরেই। ডেলিভারি দেয়। পেট খালি হলে আবার ডাউন ট্রেনে। যখন ওদের পেটে বাচ্চা আসে সেই পেটের বাচ্চার ওপর দিয়ে টাইট করে বেঁধে নেয় ওরকমই ডজন ডজন নেশার ওষুধের শিশি। টাইট করে নেশার ওষুধ বাঁধা শিশির ভেতর জীবন্ত বাচ্চা ঝিম মেরে থাকে। পেটের ভেতর লাথি মারে না। মাথা দিয়ে গুঁতো দেয় না। পোয়াতি পেট আর পেট ভর্তি নেশার ওষুধের শিশি নিয়ে মেয়েটা লাফ মারে প্ল্যাটফর্ম ঢোকার আগেই কোনও ঝোপে ঝাড়ে। টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে নিয়ে যায় হয়তো কোনও জংলা ছাপার উর্দিধারি পাহারাদার। রুলের বাড়ি পড়ে পোয়াতি শরীরের পায়ে হাতে-বুকে-পিঠে-পেটে। রাস্তায় গড়াগড়ি খায় শরীরখানা। উপর দিয়ে শিশির ভেতর নেশার ওষুধ উথালপাথাল হয়।
সন্তান প্রসব করে মা। জীবন্ত বা মৃত। ‘কানা বাপি’ ‘ল্যাংড়া আকাশ’ ‘নাটা স্বাধীন’ কোনও এক নাম নিয়ে ছেলে বড় হয়ে যায়। গনগনে আঁচে জ্বলতে থাকা আগুনে ভাত ফুটতে থাকে। শব্দ হয় ভাত ফোটার। বাইরে বন্দুকের গোলাগুলির শব্দ হয়। চিৎকার ওঠে, ‘ক্যাম্পের মাঠে গুলি খেয়ে পড়েছে রে হালদার পাড়ার কে যেন!’
হাইস্কুলের সামনে গলির মোড়ে কালো রাজুর দোকান। রাজু নামটা শুনলে যেরকম বয়সি ছেলেছোকরার মুখ মনে পড়ে, এ ঠিক সেরকম না। পাকা চুল কাঁচা চুলগুলি ঢেকে দিয়েছে। ডান পা’টায় কী যেন একটু অসুবিধা আছে। তাই কেমন একটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে পা ফেলে হাঁটে। আঁকাবাঁকা দাঁতগুলো জরদা বা গুটখাতে সাদা থেকে কালো হয়ে গিয়েছে।
মুখে পান চিবোতে চিবোতে ওর চিলতে দোকানটায় বসে বসে একদিন ওর মায়ের গল্প করছিল। –এ জায়গায় বর্ডার হয়ে কেমন একটা হয়ে গেল দিদি। সেই আমাদের বাপ-কাকাদের আমলে কাঁটাতার বসল। ঘরে ঘরে ছেলেদের হাতে কাঁচা পয়সা এল। সব ঘরে নেশা। অলস হয়ে গেল এইখানকার ব্যাটাছেলেরা। নেশা করে আমাদের এই পাড়ারই কয়জন মরল। মেয়েছেলেরাই এখানে বেশি বর্ডারে কাজ করত। ওরাই ওভাবে সংসার টানত। এখনও করে লুকিয়ে-চুরিয়ে।
মেয়েছেলেরা ওই ফেন্সিড্রিল, চিনি, লাভলি থান, ভিডিও মেশিন পেটে বেঁধে নিয়ে আসত রানাঘাট থেকে তারকনগর থেকে। সোজা চলে যেত গেদে বা এই আশেপাশে যে ফেন্সিং আছে, সেখানে। ঝোপে-ঝাড়ে সব লুকিয়ে থাকত। ওইভাবেই মেয়েছেলেরাই তো এ এলাকায় ছেলেমেয়ে মানুষ করত। কী করবে বলেন এ ছাড়া! আমার মা’ই তো কম বয়সের বিধবা। আমরা পাঁচ ভাই বোন। সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছি মা সেই কোন ভোরবেলা আমাদের জন্য ভাত ফুটিয়ে দিয়েই লাইনের কাজে বেরিয়ে যেত। তারপর আমি যখন বড় হলাম, বড় মানে কী এই এইট নাইনে, আমরাও লাইনের কাজে নেমে পড়লাম! তাও মার কত্ত টেনশন! তখন আমাদের নিয়ে টেনশন।
সেই একদিন দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর মা’র একটু চোখটা লেগে এসেছিল, স্বপ্নে দেখে কী, এই হেতের বিলের ওখানে আমি গুলি খেয়েছি! মা সেই ছুটতে ছুটতে সোজা হেতের বিলের দিকে যাচ্ছিল। আর দেখেন, ভগবানেরও কীরকম লীলাখেলা আমিও তখন ব্ল্যাকের মাল গেদেতে ডেলিভারি দিয়ে ওই হেতের বিলের সাইড দিয়ে রেল ব্রিজের নিচ দিয়েই সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলাম! দেখি, সেই আমাকে দেখে মা’র কী কান্না! কী কান্না! আসলে কী বলেন তো দিদি, এইসব লাইনে তো মরা-বাঁচার গ্যারান্টি নেই। এই দেখেন না, আমার সঙ্গেই পড়ত ছেলেগুলো, ওদের কত বার তুলে নিয়ে গেছে! কত জন বিএসএফের মার খেয়ে ল্যাংড়া হয়ে গেছে। আমিই কি কম পেটানি খেয়েছি নাকি! মরিনি– কপাল! কপাল! একটা বন্ধু তো সেই পুলিশের ভয়ে ব্ল্যাকের তিন-চারটে ভিসিডি মেশিন নিয়ে গেদে প্যাসেঞ্জারের দুটো বগির জয়েন্টের ওখানটায় কোনওরকমে দাঁড়িয়ে ডেলিভারি দিতে যাচ্ছিল গেদেতে। যেই রাণাঘাট পেরিয়ে গেদে লাইনে ট্রেন ঢুকবে ক্রসিংয়ে ক্যাঁচকোঁচ করে ঝাঁকুনি মারল, ব্যাস! অমনি একদম তলায়। সেই ভিসিডি মেশিনগুলোও গেল বন্ধুটাও সোজা উপরে। এইরকমই দিদি। মা মরেছে কত বছর হল। এখনও ভুলিনি দিদি সেই সিনটা, সেই যে মা অমন কাঁদতে কাঁদতে ছুটছিল হেতের বিলের দিকে…
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.