গ্রাফিক্স: সুলগ্না ঘোষ
সীমান্ত ও সিনেমা শব্দ দু’টোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ‘মা’। সীমান্তকেন্দ্রিক ছবির মায়েরা কীরকম? ধূ ধূ প্রান্তরের মতো নিঃস্ব? একচোখে অপেক্ষা আর একচোখে আক্ষেপ? লিখছেন রণদীপ নস্কর।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে আহত, গুলিবিদ্ধ সৈনিক বালিতে পড়ে কাতরাচ্ছেন। সামনে বিপক্ষের উদ্যত ট্যাঙ্ক। গোলায় আঙরা হয়ে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা। তবু, কী এক আশ্চর্য অব্যাখ্যাত প্রাণশক্তিতে তিনি মুঠো ভরে বালি কুড়িয়ে চিৎকার করছেন, ‘শক্তি দাও, মা!’
ওই যুদ্ধেই তাঁর এক সহযোদ্ধা সারা শরীরে অজস্র গুলি খেয়ে যখন ক্লান্ত, মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে বসে আছেন ট্রেঞ্চে, তখন তাঁর স্বপ্নে ফিরে আসে তাঁর অন্ধ মা– স্বামীকে হারিয়েছেন যুদ্ধে, এই জগতে একমাত্র অবলম্বন তাঁর পুত্র। ছেলে বাড়ি ফিরলে তাঁর বিয়ে দেবেন, এই আশায় বোনেন বিয়ের মুকুট। ছেলে আর কোনও দিন ফিরবে না। বিয়েও দেওয়া হবে না তাঁর।
জেপি দত্ত’র শোরগোল ফেলে দেওয়া ছবি ‘বর্ডার’-এর অন্তিম দৃশ্যের দুই খণ্ডচিত্র। চরিত্র দু’টিতে যথাক্রমে অভিনয় করেছিলেন সুনীল শেট্টি এবং তরুণ অক্ষয় খান্না। এই দেশে নয়ের দশকে যে সামরিক অ্যাকশন ছবিগুলো তৈরি হয়েছে, তাতে এই দুই মায়ের ছবি বারবার ধরা পড়বে: একদিকে খোদ দেশমাতৃকা, আর আরেকদিকে রক্তের সম্পর্কের মা- যাঁর স্বামী অথবা পুত্র গিয়েছেন সামরিক বাহিনীতে, দেশের স্বার্থে যুদ্ধ করছেন সীমান্তে; আর তিনি পথ চেয়ে নিরন্তর প্রতীক্ষা করে চলেছেন। এই দুই মাতৃচরিত্র বারবার ফিরে এসেছে উল্লিখিত ছবিগুলোয়।
পুরোপুরি ‘সামরিক অ্যাকশন’ ছবি না হলেও, আব্বাস-মস্তানের ‘সোলজার’ ছবিটি এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেন? ভিকি ওরফে ববি দেওলের একটি সংলাপ স্মর্তব্য। ছবির শেষদিকে তিনি শান্তি সিনহা ওরফে ফরিদা জালালকে বলছেন, “ঈশ্বরের দেওয়া সব থেকে বড় উপহার হল মা। আর, আমি তো ভাগ্যবান, আমি এক জীবনে দু’জন মা-কে পেয়েছি।” এই ছবিতে দেশমাতৃকা আর ব্যক্তি মা– এই দুই সত্তা দুই আলাদা মানুষের মধ্যে ধরা দিয়েছিল। ফরিদা জালাল রক্তের সম্পর্কের মা না হয়েও ভিকির জীবনে মায়ের দায়িত্বটি পালন করেছিলেন– ভিকির বাবা কুটিল অফিসারদের ষড়যন্ত্রে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত হওয়ার পর, গ্রামবাসীর অত্যাচারে যখন ভিকি আর তার মা-র জীবন জর্জরিত, তখন তিনিই ভিকিকে ওই গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন, কোলেপিঠে করে মানুষ করেন। যে কুটিল অফিসারদের কুচক্রে ভিকির বাবাকে খুন হতে হল, তাদের মধ্যে তাঁর স্বামীও ছিল। তা-ও, তিনি ভিকির সহমর্মী হয়ে উঠতে দ্বিধান্বিত হননি; বরং নিজের স্বামীকে এককথায় পরিত্যাগ করেছেন। আর এঁর সমান্তরালে আছেন গীতা মালহোত্রা। ঘটনাচক্রে ‘বর্ডার’-এ অক্ষয় খান্নার অন্ধ মা আর এই চরিত্রে একই অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন– রাখী গুলজার। স্বামীর শবদেহ দাহ করতে দেয়নি গ্রামবাসী, দেশবিরোধী লোকের চিতা জ্বলবে না, এই মর্মে দেহ চিতা থেকে ফেলে দিয়েছে। মরুঝড়ে স্বামীর দেহ হারিয়ে গেছে বালির মধ্যে। আর সেই অনন্ত মরুভূমির পাশে একটা মন্দিরে বসে স্বামীর ন্যায়বিচারের অপেক্ষা করেন হা-ক্লান্ত, বিধবা, গাঁ থেকে বিতাড়িত স্ত্রী। প্রতীক্ষা করেন, কবে ছেলে বড় হয়ে, মানুষের মতো মানুষ হয়ে তার বাবার জন্য ছিনিয়ে আনবে ইনসাফ। ফরিদা জালাল-অভিনীত শান্তির সঙ্গে রাখী-অভিনীত গীতার এক অদ্ভুত সম্পর্ক এই ছবিতে। শান্তির স্বামী ষড় করে গীতার স্বামীকে খুন করেছে, দেশবিরোধী হিসেবে খাড়া করেছে; অথচ, গীতার পুত্রকে ন্যায়বিচার আনার পথে ঠেলে দিয়েছে শান্তিই। সোচ্চারে স্বামীর মুখের ওপর বলেছে, ‘দেশের সঙ্গে বেইমানি করলে তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না।’
অতএব, এখানে দেশমাতৃকার সঙ্গে নিজের মা-র সম্পর্কটা জরুরি হয়ে ওঠে। দেশের সঙ্গে বীরেন্দর সিনহা ওরফে দলীপ তাহিলরা যখন বেইমানি করেন, তখন সেই ঘটনার পরিণতি হিসেবেই নিঃস্ব হন আরেক মা– গীতা মালহোত্রা। আর এই বিশ্বাসঘাতকতার জেরেই রাখী গুলজারের চরিত্রটি উত্তীর্ণ হবে দেশের শাশ্বত নারী প্রতিকল্পে: যে মাটি তার সাহসী সন্তানকে বালির চাদরে ঢেকে বুকে আগলে রেখেছে, তার পাশে ঠায় বিশ বছর বসে থাকবে শান্তি মালহোত্রা। অতএব, ‘সোলজার’ ছবিতে দুই মা’র ছবি দুই নারীচরিত্রে ধরা পড়ে। এই ছবি আব্বাস-মস্তানের স্বভাবসিদ্ধ দ্রুত কাটের অ্যাকশনসর্বস্ব, অধিকাংশক্ষেত্রেই যুক্তিবুদ্ধির ধার না ধারা ফিল্মোগ্রাফির আরেক উজ্জ্বল নাম বটে; কিন্তু এই দুই দৃঢ় নারীচরিত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে অন্তত ‘সোলজার’ নিয়ে কিছুটা ভাবনাচিন্তা করার অবকাশ থাকে।
এই দেশমাতৃকা আর্কিটাইপের সূত্রেই মিলে যায় ‘বর্ডার’ আর ‘সোলজার’। ‘সোলজার’-এ বালির উপর পড়েছিল গীতা মালহোত্রার পায়ের ছাপ। মা-কে ছেড়ে চলে আসার সময়ে মায়ের পায়ের ছাপ পড়া বালি কিছুটা কুড়িয়ে আনে ভিকি; সারাজীবন লকেটে রেখে দেয় সেইটুকু স্মৃতি। আর ‘বর্ডার’-এ ভৈরব সিং ওরফে সুনীল শেট্টিও সেই রুক্ষ প্রান্তর আঁকড়ে ধরেই চিৎকার করে ওঠে, ‘ইয়ে ধরতি মেরি মা হ্যায়’। লক্ষণীয়, ভৈরব সিং দেশকেই মায়ের আসনে এমনভাবে বসিয়ে ফেলেছে, তার নিজের মা-কে ছবিতে দেখানোই হয় না। ‘দেশমাতৃকা’ বললেই যে শস্যশ্যামলা সবুজ ধরিত্রীর কথা ভেসে ওঠে, তার বিপরীতে এই দুই ছবিতেই রুক্ষ মরুপ্রান্তরের ছবিটা বারবার ফুটে উঠছে। এই নিয়ে মথুরাদাসের সঙ্গে ভৈরব সিংয়ের রীতিমতো তর্ক বেঁধে যায়, ভৈরব সিং বলে, ‘এই রুক্ষ প্রান্তর, এই কাঁটাঝোপ, মাইলের পর মাইল পড়ে থাকা বালিও আমার দেশ; অতএব, আমার মাটি, আমার মা।’ এই ধরনের ছবিতে মায়েদের যে বেদনাবিধুর অপেক্ষাটি আছে, তার জন্যই কি বারবার এই রুক্ষ প্রান্তরের ছবিটা উঠে এসেছে? মানে, যদি এই ছবিগুলোর সমান্তরালে ‘স্বদেশ’-কে কল্পনা করা যায়, তাহলে একটা ইন্টারেস্টিং প্যারালাল তৈরি করা যায়। মোহন ভার্গভ যখন ঋণ আদায় করতে গেছে দূরের গ্রামে, তখন গীতা তার ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকে। তৈরি হয় অপূর্ব একটি গানের দৃশ্য: ‘সাওয়ারিয়াঁ’, অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া, রহমানের অবিস্মরণীয় সুর। সেই গানেও অপেক্ষা আছে, কারও ফেরার পথ চাওয়া আছে। অথচ, ভিজ্যুয়াল অত্যন্ত বর্ণময়, শ্যামলিমায় ভরা। সেই অপেক্ষার পূর্ণতা পাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা আছে। বস্তুত, ভারতের সাহিত্যের নারীচরিত্রের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে বারবার কারুর জন্য অপেক্ষার ব্যাপারটা খুঁজে পাওয়া যাবে। শকুন্তলা দুষ্মন্তের জন্য অপেক্ষা করছে, যামিনী (যদিও তার বয়ান অনুপস্থিত) নিরঞ্জনের পথ চেয়ে আছে, ভানুসিংহের পদাবলীর অধিকাংশই কৃষ্ণের জন্য রাধার অপেক্ষার অতুলনীয় ডকুমেন্টেশন। সেই অপেক্ষারই সম্প্রসারণ ‘স্বদেশ’-এর এই অংশটুকু। কিন্তু আমাদের আলোচ্য ছবিগুলোয় অপেক্ষার এতটা রোম্যান্টিক ভার্সন পাওয়া সম্ভবই না, কারণ সেখানে আর কোনও দিন ফিরে না আসার সম্ভাবনাটিও ফিরে আসার সম্ভাবনার মতোই জোরালো। তাই বারবার মায়েদের কথা মনে পড়তেই উঠে এসেছে রুক্ষতা, শূন্যতা, সীমাহীন ধূ ধূ প্রান্তরের ছবি।
অতএব, এই সামরিক অ্যাকশন ছবিগুলোয় মা একক ব্যক্তিচরিত্র নন, সেই চরিত্রের দু’টো দিক রয়েছে। একদিক অবশ্যই ব্যক্তি মা। যিনি সন্তানের পথ চেয়ে অবিরাম বসে থাকেন শূন্য চোখে। যাঁর সন্ধে নামে সন্তানের মঙ্গলকামনায়, কিন্তু সন্তান কোথায়, কী অবস্থায় আছে– তিনি জানেন না। সন্তান কখনও কখনও ফেরে কফিনে শুয়ে। তিনি আছড়ে পড়েন কফিনের ওপর। আর দ্বিতীয় দিকে দেশমাতৃকা। তার প্রতিকল্প হয়ে কখনও কখনও কোনও চরিত্র আবির্ভূত হন, ‘সোলজার’-এর রাখী গুলজার যেমন। এই নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘বর্ডার’-এর মথুরাদাসের সংলাপ। মুমূর্ষু সৈনিক বলে ওঠেন, ‘আমার স্ত্রী-কে বলে দেবেন, পরের জন্মে ওঁর ঋণ শোধ করে দেব। এই জন্মে আমার দেশ মা-র ঋণটা চুকিয়ে যাই।’ এই ছবিগুলোয় নিজের মায়ের কোলে ফেরা না হলে সেনারা চলে যান দেশমাতৃকার কোলে, সেখানে নক্ষত্রের আলোয় চিরঘুম নেমে আসে। দেশের মানুষ একটা সময়ের পর মেনে নিয়ে এগিয়ে যায়। পাড়াপড়শিরা সাময়িক সান্ত্বনার পর নিজ নিজ জীবনে ফিরে যায়। আত্মীয়-স্বজন, মেনে নেয় তারাও। কিন্তু মানতে পারেন না এক মা, তিনি তখনও সন্তানের ফেরার অপেক্ষায় বসে আছেন ঠায়, দরজার ঠিক সামনে, দাওয়ায়– যদি এসে তাঁর সন্তান কড়া নাড়ে, দরজা খুলতে হবে না?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.