টগবগ করা ক্রোধ, ক্ষোভ ও প্রত্যাঘাতের প্রত্যাশায় প্রতীক্ষারত জনতাকে জাতগণনার সিদ্ধান্ত জানানো, এই যুদ্ধের আবহে, এককথায় অকল্পনীয়! অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স! তড়িঘড়ি বিহারে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি তা-ও করলেন। কারণ, ধর্মীয় কারণে ‘নিষ্পেষণ’-এর অভিযোগে বিজেপি যাদের চক্ষুশূল, তাদের একাংশকে কাছে টানতে চাইছেন তিনি সুচারুভাবে। ভোট যে বড় বালাই! লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
পহেলগাঁও হত্যালীলার খবর পেয়ে সৌদি আরব থেকে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেও প্রধানমন্ত্রী কেন যোগ দেননি, এত দিনে তা জলের মতো স্বচ্ছ। কেন তিনি হুট করে বিহার চলে গেলেন, সেখান থেকে অপরাধীদের ‘অকল্পনীয় শাস্তি’ দেওয়ার হুংকার ছাড়লেন, এবং দিল্লি ফিরে আর সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার গরজ দেখালেন না, এখন তা বুঝতে বিশেষ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।
সহজ ব্যাখ্যা, বৈঠকে থাকলে পহেলগাঁওয়ের দায়ভার নিতে হত। অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত। সরকারি ব্যর্থতা ও গোয়েন্দা গাফিলতির জবাবদিহি করতে হত। প্রশ্ন শোনা মোদির চরিত্র-বিরোধী। ১১ বছর ধরে তাই সংসদে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। সাংবাদিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও প্রশ্ন করার অধিকার যে গণমাধ্যমকর্মীদের আছে, তা ভুলিয়ে ছেড়েছেন। পুলওয়ামা ও গালওয়ান নিয়েও আলোচনার অনুমতি দেননি। সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলেও তাই নিজে গরহাজির থাকলেন।
সার্থক প্রত্যাঘাতের পর আরও একবার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলেন। এবার তঁাকে জবাবদিহি করতে হত না। বরং সাফল্যের সাতকাহনের খতিয়ান দিতে পারতেন। বালাকোট নিয়ে অনেক সন্দেহ ও সংশয় ছিল। এবার হাতেগরম প্রমাণ গাদা-গাদা। জোর করে কোনও ‘দাবি’ জানাতে হত না। তবুও তিনি বৈঠকে যোগ দিলেন না। এর মধ্য দিয়ে সম্ভবত এই বার্তাই দিতে
চান যে, বাকিরা সব লিলিপুট, তিনি একাই গালিভার। তিনি চলেন, চলবেনও নিজস্ব দুলকিতে।
সে যাকগে, পুরনো প্রশ্নটা তবু থেকেই যায়, হুট করে ২৪ এপ্রিল সর্বদলীয় বৈঠক এড়িয়ে বিহারে যাওয়ার কোন প্রয়োজনটা প্রধানমন্ত্রীর ছিল?
উত্তরটি অঘোষিত। হয়তো এক ধরনের অনুচ্চারিত স্বীকারোক্তিও, যার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট প্রতিভাত, বিহার বড় বালাই। নইলে গোটা দেশ যখন ‘মুহ্ তোড়’ জবাবের প্রতীক্ষায়, তখন বলা নেই কওয়া নেই দুম করে জাতগণনার সিদ্ধান্ত মোদি নিতেন না। একটু ভেবে দেখুন, টগবগ করা ক্রোধ, ক্ষোভ ও প্রত্যাঘাতের প্রত্যাশায় প্রতীক্ষারত জনতাকে জাতগণনার সিদ্ধান্ত জানানো, এই যুদ্ধ আবহে, এককথায় অকল্পনীয়! অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স! অকল্পনীয় ও বিস্ময়কর আরও এজন্য যে, আরএসএসের পক্ষপুটে লালিত, পালিত ও আশ্রিত ‘মনুবাদী’ বিজেপি আজন্ম জাতগণনা-বিরোধী। ব্রাহ্মণ্যবাদে ঘোর বিশ্বাসী বলেই নীতি ও আদর্শগতভাবে তারা জাতগণনার বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লোকসভায় জানিয়ে ছিলেন, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তফসিলি জাতি ও উপজাতি ছাড়া জনগণনার সময় জাতভিত্তিক গণনা হবে না।
এই সিদ্ধান্ত নীতিগত।’ ওই বছরেই সুপ্রিম কোর্টে সরকার হলফনামায় বলেছিল, ‘জাতগণনা প্রশাসনিক দিক থেকে কঠিন ও অসুবিধাজনক।’ দু’-বছর পর, ২০২৩ সালে, আরজেডি ও কংগ্রেসের দোসর থাকাকালীন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার জাতগণনা করিয়েছিলেন। সমালোচনায় মোদি বলেছিলেন, ‘রাজ্যবাসীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নীতীশের জেডিইউ পাপ করছে।’ বিহারের পর জাতগণনা হয়েছে কংগ্রেস-শাসিত কর্নাটক ও তেলেঙ্গানাতেও। মোদি বলেছিলেন, ‘বিরোধীরা সমাজটা রসাতলে পাঠাচ্ছে।’ সেই ‘মোদি অ্যান্ড কোং’-এর কাছে জাতগণনার ঘোষণা এখন ‘বিহার জয়ের বটিকা’! নীতিগত প্রশ্নে ১৮০ ডিগ্রি পাল্টি খাওয়ার চমকপ্রদ নমুনা। বিজেপির মতোই জাতগণনায় সম্মতি ছিল না কংগ্রেসেরও। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম জনগণনার সময় জওহরলাল নেহরু জাতগণনা না-করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘জাতপাতহীন নতুন ভারত গড়ে তোলার তাগিদ’ থেকে।
সেই থেকে কংগ্রেস জাতগণনার বিরুদ্ধে। অবস্থানের বদল ঘটে ২০১১ সালের জনগণনার সময়। মনমোহন সিং জাতগণনার বিষয়টি ‘ঐচ্ছিক’ রেখেছিলেন। অর্থাৎ, বাধ্যবাধকতা নয়,
যার বলার সে বলবে। গণনা শেষে সরকার সেই ফল প্রকাশ করেনি জাত তথ্যে ‘ভুলভ্রান্তি’ থাকার দরুন। কোণঠাসা কংগ্রেসের অবস্থান পুরোপুরি ঘুরে যায় ২০২৪ সাল থেকে। রাহুল গান্ধী ‘যিতনি আবাদি উতনা হক’ স্লোগানটি নতুন করে তুলে দেন। জানান, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে জাতগণনার পাশাপাশি আনুপাতিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা কায়েম করবে। সরকারি ও বেসরকারি দুই স্তরেই। আপাতত চলছে কৃতিত্বের দাবি ঘিরে পারস্পরিক তরজা। বিজেপি বলছে, কংগ্রেস এতকাল যে-সাহস দেখায়নি, মোদি তা দেখিয়ে দিলেন। কংগ্রেসের পোস্টার-হোর্ডিংয়ে লেখা– রাহুলের দাবির মুখে মোদি সরকার বাধ্য হল মাথা নোয়াতে। এ জয় কংগ্রেসের।
মুহূর্তের মধ্যে পহেলগাঁওয়ের দখল করা জায়গা সাময়িকভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিল জাতগণনা। ৯টি শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করার পর ভারতীয় সেনানীদের বীরগাথা চর্চায় চলে এলেও পরবর্তীতে বিহারের ভোট যত এগবে, ততই প্রাধান্য পাবে জাতগণনার সিদ্ধান্ত। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পাশাপাশি বিহার-জয়ে এটাও হতে চলেছে বিজেপির আরও এক তুরুপের তাস।
এটাও মোদির বোধোদয় বইকি! তিনি বুঝেছেন, বিহারে ক্ষমতায় থাকতে হলে জাতগণনার সুরে গলা না-মেলালে বিপদ। এখনকার নীতীশ কুমার অতীতের ছায়ামাত্র। বহুলাংশে তিনি ম্রিয়মাণ ও ক্ষীয়মাণ। জেডিইউয়ের মতো বিজেপির বাকি শরিকরাও প্রবলভাবে জাতগণনার পক্ষে। নীতীশের মতো একই সুর চিরাগ পাসোয়ান, জয়ন্ত চৌধুরী, জিতনরাম মাঞ্ঝি, অনুপ্রিয়া প্যাটেলদের। জাতগণনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব আরজেডি ও কংগ্রেস। শুধু গণনা নয়, রাহুল গান্ধী-তেজস্বী যাদবরা জানিয়েছেন, সংরক্ষণের সীমা ৫০ শতাংশের বেশি বাড়াতে সচেষ্ট হবেন।
বিজেপির এই পাল্টি খাওয়ার অন্য কারণ ওয়াকফ আইন। এই আইন সমর্থন করে মুসলমানদের ক্ষোভের মুখে পড়েছে জেডিইউ, এলজেপি, আরএলডি, টিডিপি, হাম, আপনা দলের মতো বিজেপির জাতভিত্তিক শরিকরা। দিন কয়েক আগে দিল্লিতে এক সম্মেলনে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’ ও বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের নেতারা দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছেন, শরিকরা ওয়াকফ আইন প্রত্যাহারে বিজেপিকে বাধ্য না-করলে মুসলমান সমাজের রোষ, ক্রোধ, ক্ষোভ ও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। এতে তারা চিন্তিত। শঙ্কিত। কারণ, বিজেপির দোসর হলেও মুসলমান ভোট তারা পায়। এই পরিস্থিতিতে জাতগণনায় সম্মত হয়ে বিজেপি চাইছে শরিকদের তুষ্ট রাখতে। তাই, কিছু দিন আগেও যিনি বলেছিলেন তঁার দৃষ্টিতে জাত চারটি– দরিদ্র, নারী, কৃষক ও যুবা– সেই মোদি জাতগণনার ঢেঁকি গিলে বোঝালেন, নীতি ও আদর্শের চেয়ে বেশি জরুরি ভোট। ভোট রাজনীতি বড় বালাই।
অবশ্য, জাতগণনায় রাজি হওয়ার পিছনে মোদির অন্য একটা অঙ্কও আছে। সেটাও ভোট রাজনীতি। পসমন্দা মুসলমান। ‘পসমন্দা’ শব্দটি পারসি। অর্থ, ‘পিছিয়ে পড়া’। অনগ্রসর। মুসলমানদের এই শ্রেণিকে কাছে টানতে মোদি বেশ কিছু দিন ধরেই সক্রিয়। এমনিতে ইসলামে শ্রেণি বিভাজন না-থাকলেও মণ্ডল
কমিশন জানিয়েছিল, মুসলমানদের কোনও কোনও শ্রেণি কেন্দ্র ও রাজ্যের অনগ্রসর তালিকাভুক্ত। ২০১১ সাল পর্যন্ত জনগণনায় মুসলমানরা অবশ্য ‘সম্প্রদায়’ হিসাবেই গণ্য হয়েছে। জাতভিত্তিক নয়। ‘সাচার কমিটি’-র হিসাবে মুসলমানদের মধ্যে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর ৪০ শতাংশ। যদিও বিজেপির অনগ্রসর মোর্চার সভাপতি কে. লক্ষ্মণ ও সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি জামাল সিদ্দিকির দাবি, পসমন্দা মুসলমানের হার ৮০ শতাংশ। তঁারা জানিয়েছেন, জাতগণনায় এঁরা সবাই নিজেদের সেভাবেই নথিভুক্ত করবেন। বিহারের জাতগণনায় পসমন্দার হার ছিল ৭১ শতাংশ, তেলেঙ্গানা ও কর্নাটকে ৮০ শতাংশ।
রাজনীতি চিরকালই বিচিত্র। ধর্মীয় কারণে ‘নিষ্পেষণ’-এর অভিযোগে বিজেপি যাদের চক্ষুশূল, তাদের একাংশকে কাছে টানতে জাতগণনার টোপ ফেলে নরেন্দ্র মোদি রাজনীতিকে বৈচিত্রপূর্ণ করে তুলেছেন। কেন তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা, ‘যুদ্ধ, যুদ্ধ’ আবহে এই চাল তার অনন্য উদাহরণ।
পহেলগাঁও ‘মুহ্ তোড়’ জবাবের পর বর্ষশেষের ভোটে বিহার জয় ঘিরে সন্দেহের চাদর কর্পূরের মতো উবে যাওয়ারই কথা। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর সাফল্যের সঙ্গে জাতগণনা যখন ‘সুগ্রীব দোসর’। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ছাড়া জাতগণনার মতো কোনও নীতিগত প্রশ্নে এই প্রথম রাম-রহিম, যদু-মধু, সীতা-গীতা, হরি-হরিহর সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে পড়ল।
(মতামত নিজস্ব)
saumyabandyo@gmail.com
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.