মন্ত্রপাঠ, জপ ও ধ্যান, বা কীর্তনেই কি ঈশ্বরসাধনা সীমিত? ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ বা ‘শ্রী রামকৃষ্ণ প্রচার’ বদলে দিয়েছিল আরাধনার অর্থ ও নির্মাণ। পয়লা মে এই প্রতিষ্ঠানের জন্মদিন। লিখেছেন রবিব্রত ঘোষ।
সেটাও ছিল এক পয়লা মে। ঘটনাটা ভারতের, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাংলার, বাঙালির। মাস চারেক আগে বিবেকানন্দ ফিরে এসেছেন ঐতিহাসিক শিকাগো ধর্ম মহাসভা এবং পাশ্চাত্য-বিজয় সেরে। মে মাসের ১ তারিখে উত্তর কলকাতায় শ্রীরামকৃষ্ণর ভক্ত বলরাম বসুর বাড়িতে (যা এখন রামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলে ‘বলরাম মন্দির’ নামে পরিচিত) এক সভা ডেকে বিবেকানন্দ এবং তঁার গুরুভাইরা– যঁার নাম নিয়ে, যঁারা আদর্শ নিয়ে সন্ন্যাসী হয়েছেন, এবং সাধারণ ভক্তরা যঁাকে জীবনে তঁাদের ‘প্রাণপুরুষ’ বলে মনে করেন– সেই শ্রীরামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে এক নতুন সংগঠন তৈরি করার কথা ঘোষণা করলেন। সংগঠনের নাম: ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ বা ‘শ্রী রামকৃষ্ণ প্রচার’।
সমকালীন নথিপত্রে পাওয়া যায়, এই নতুন প্রতিষ্ঠানের কর্মধারা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, ‘মিশনের উদ্দেশ্য মানবের হিতার্থে শ্রীরামকৃষ্ণ যে সকল তথ্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন, এবং কার্যে তাহার জীবনে প্রতিপালিত হইয়াছে তাহার প্রচার এবং মানুষের দৈহিক মানসিক ও পরমার্থিক উন্নতিকল্পে যাহাতে সেই সকল তত্ত্ প্রযুক্ত হইতে পারে সেই বিষয়ে সাহায্য করা মিশনের উদ্দেশ্য। মিশনের ব্রত জগতে যাবতীয় ধর্ম মত এবং অক্ষয় সনাতন ধর্মের রূপান্তর মাত্র জ্ঞানে সকল ধর্মাবলম্বনীদের মধ্যে আত্মীয়তা স্থাপনের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ যে কার্যের অবতারণা করিয়াছিলেন তাহার পরিচালনায় এই মিশনের ব্রত। মিশনের কার্যপ্রণালী মানুষের সাংসারিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বিদ্যা দানের উপযুক্ত লোক শিক্ষিত করণ শিল্প ও শ্রমোপজীবিকার উৎসাহ বর্ধন এবং বেদান্ত ও অন্যান্য ধর্ম ভাব রামকৃষ্ণ জীবনে যেভাবে ব্যাখ্যাতো হইয়াছিল তাহা জনসমাজে প্রবর্তন। ভারতবর্ষীয় কার্য ভারতবর্ষের নগরে নগরে আচারব্রত গ্রহনাভিলাষী গৃহস্থ বা সন্ন্যাসী দিগেরর শিক্ষার আশ্রম স্থাপন এবং যাহাতে তাহারা দেশ দেশান্তরে গিয়া জনগণকে শিক্ষিত করিতে পারে তাহার উপায় অবলম্বন।’
ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, বড় সভা-সমাবেশ করে, এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়নি। লোকসমাজের অগোচরেই এই প্রতিষ্ঠানটি পথ চলা শুরু করেছিল, আসলে এগুলো ছিল পুরনো ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে এক নতুন পথচলা। ভারত অসংখ্য ধর্মের দেশ। এখানে যেমন হিন্দু আছে, খ্রিস্টান ও মুসলিম আছে, তেমনই আছে শিখ-পারসিক-জৈন। আবার হিন্দু ধর্মের অসংখ্য সম্প্রদায়, উপ-সম্প্রদায়, তাদের শাখাপ্রশাখাও রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর এই জাগরণ একটি প্রশ্নের উদয় ঘটিয়েছিল– সব ধর্মের লক্ষ্য কী এক? রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাণপুরুষ, শ্রীরামকৃষ্ণ তঁার জীবনব্যাপী সাধনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন সব ধর্মের একই লক্ষ্য। সরল বাংলায় বলতে পেরেছিলেন, ‘যত মত তত পথ’। সব পথ দিয়েই বিশ্বাসী পেতে পারে ঈশ্বরকে। ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়লে দেখা যায়, তিনি লৌকিক উপমা প্রদান করে তঁার বক্তব্যকে বোঝাতে পেরেছিলেন। বিবাদ-বিসম্বাদ, কটূক্তি-কটাক্ষ, সম্মান-অসম্মান, আঘাত-প্রত্যাঘাতের প্রেক্ষাপটে নতুন যুগের সূচনা করে দিয়েছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথার মধ্য দিয়ে। সমকালীন সময়ে শাক্ত ও বৈষ্ণবের তীব্র দ্বেষর বিপরীতে দঁাড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে কৃষ্ণর পুজো শুরু হল, রামচন্দ্রের পুজো শুরু হল, শুরু হল দুর্গা আর কালীর পুজো। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল চৈতন্যদেবের জন্মদিন পালন, বুদ্ধদেবের জন্মদিন পালন, এমনকী যিশুর জন্মদিন পালও। শুধু ভারত কেন, বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতার এ এক আশ্চর্য সমন্বয়!
এর সঙ্গেই এল ধর্মীয় সংগঠন পরিচালনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। শংকরাচার্য সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন। বিদ্যারান্য মুনি নাগা সন্ন্যাসীদের সংগঠিত করেন। বুদ্ধদেব প্রথম সন্ন্যাসী সম্প্রদায় সৃষ্টি করে তাকে সংঘটিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণর নামে এই নতুন ধর্মীয় সংগঠন এক অভিনব পথ দেখাল– এ এমন এক সংগঠন, যা শুধুমাত্র সাধু-সন্ন্যাসীতেই সীমিত না থেকে নয়, গৃহস্থ মানুষেরও অধিকার স্থাপন করল। কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহণের অধিকার কায়েম করল। সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী এবং সংসারের মধ্যে থাকা গৃহস্থদের এক নতুন ধরনের সমন্বয় তৈরি হল এই সংগঠনের প্রেক্ষাপটে।
তখন ভারতীয় সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মানেই ছিল এককেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা। রাজা-মহারাজাদের মতো করেই ধর্মীয় সংগঠন পরিচালনা করার চল ছিল। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক চিন্তাধারায় নতুন ধারার সৃষ্টি করল রামকৃষ্ণ মিশন। সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচন শুরু হল পরিচালক মণ্ডলী। এই প্রথম গণতান্ত্রিক ধারণা কোনও ধর্মীয় সংগঠনের পরিচালন পদ্ধতিতে অঙ্গীভূত হল। এ এমন এক সময়– যখন ভারতের গণতান্ত্রিক রূপ নিতে প্রায় আরও ৫০ বছর বাকি!
তখনকার সমাজে সমভারতীয় ধর্মে ব্রাহ্মণদের চূড়ান্ত অধিকার। রামকৃষ্ণ মিশনই প্রথম– যেখানে ব্রাহ্মণ ছাড়াও শূদ্র এবং অব্রাহ্মণদের সন্ন্যাসের অধিকার দেওয়া হয়। পরে এই অধিকারে অ-হিন্দুদেরও শামিল করা হবে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এল সামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে। শ্রীরামকৃষ্ণর উপদেশে ‘সেবা’-র ধারণা পেল নতুন রূপ। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উত্থানে বলা হল– ভগবান কি শুধু বিগ্রহ বা ছবিতে রয়েছেন? এই যে ব্রহ্মাণ্ড, এই যে জীবজগৎ, এর সারাৎসার সতো একই ঈশ্বরের মূর্তরূপ। শুধু মানুষ কেন সমস্ত জীবজগতের মধ্যেই সেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। তঁার কথা মেনে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সন্ন্যাসীরা নিয়োজিত হলেন জীবসেবায়।
তিনি আরও বললেন, পুজো মানে কি খালি মন্দিরে কঁাসর-ঘণ্টা বাজানো, মন্ত্রপাঠ, জপ-ধ্যান কীর্তন? সেক্ষেত্রেও এক নতুন নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন পরমহংসদেব। সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ এক সুরে বললেন, আমি সেই ‘ঈশ্বর’-এর পূজা করি, অজ্ঞানীরা যাকে ‘মানুষ’ বলে জানে। পুজোর উপাচার হয়ে উঠল অন্যরকমের। চিরাচরিত পুজোপাঠ, মন্ত্রোচ্চারণের বদলে ক্ষুধার্ত মানুষের পুজো হয়ে উঠল– তাদের অন্নদান করা।
পীড়িত মানুষের পুজো হয়ে উঠল– তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করা। দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ পরিষেবা দেওয়া মান্যতা পেল পুজোর সম-স্বীকৃতি। দীর্ঘ কাল ধরে ভারতীয়রা ধর্মসাধনায় গুরুত্ব দিয়ে এসেছে জ্ঞান, ভক্তি ও যোগকে। ধার্মিক মানুষেরা হয়ে উঠেছিলেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক– সমাজ নিয়ে তাদের ছিল না সাধনা। উনবিংশ শতাব্দীতে অনেকেই পণ্ডিত ছিলেন, মানবতাবাদী ছিলেন– কিন্তু দেশের দরিদ্র ও অনুন্নত সমাজের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হতে পেরেছিল কি? স্বামীজির কর্মযোগের বাণী আর সন্ন্যাসীদের সেবামূলক কাজ– নতুন দিগন্ত খুলে দিল। সামাজিক উন্নয়নেও যে ধর্মকে কাজে লাগানো যায়, সে-বার্তা ছড়িয়ে পড়ল।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘নিষ্কাম কর্ম’-র কথা বলেছেন, দেশমাতৃকার কথা বলেছেন– কিন্তু সবই সীমিত ছিল তঁার উপন্যাসে। এর বাস্তবায়ন যেন ঘটল– রামকৃষ্ণ মিশনের কাজে। মিশন প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্য অখণ্ডানন্দজির নেতৃত্বে সারগাছিতে সেবা, কলকাতায় প্লেগের সময় রামকৃষ্ণ মিশনের সেবামূলক অবদান– মানুষের মধ্যে ধর্মের ধারণাটাকেই পাল্টে দিতে পেরেছিল। ধার্মিক হওয়ার জন্য সমাজে থেকে মানুষের সেবা করে উচ্চ-আধ্যাত্মিক অবস্থান লাভ করা সম্ভব– রামকৃষ্ণ মিশনের সাধু-সন্ন্যাসীরাই প্রমাণ করতে পেরেছিলেন।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.