Advertisement
Advertisement
Mothers of India

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী

দেশ যদি মাতৃস্বরূপা না হত যুদ্ধে যাওয়া সৈনিকদের ভিতরে সেই আবেগ ভর করত?

Special write up on Mothers of India by Amar Mitra

গ্রাফিক্স: সুলগ্না ঘোষ

Published by: Sulaya Singha
  • Posted:May 10, 2025 11:45 pm
  • Updated:May 11, 2025 3:16 pm  

যুদ্ধ লেগেছে। যুদ্ধে যাঁরা দেশরক্ষায় প্রাণ দিচ্ছেন, তাঁদের মায়ের কোলগুলি খালি হচ্ছে। সে কোল শুধু সেই দূর মফসসলের, গাঁয়ের মায়ের কোলটি নয়, দেশ মাতৃকার কোলও তো। দেশ যদি মাতৃস্বরূপা না হত যুদ্ধে যাওয়া সৈনিকদের ভিতরে সেই আবেগ ভর করত? লিখছেন অমর মিত্র

মায়ের মূর্তি গড়াতে চাই, মনের ভ্রমে মাটি দিয়ে।
মা বেটি কি মাটির মেয়ে, মিছে খাটি মাটি নিয়ে।

Advertisement

সাধক রাম প্রসাদ কত রকমে না মাকে দেখেছেন। সে মা তাঁর আরাধ্য দেবী, শ্যামা মা, মুণ্ড মালিনী। তাঁর বরণ কালো। আমি দেখেছি কালো বরণ মায়ের কালো বরণ সন্তান। সেই মা আমার কল্পনার, আবার বাস্তবেরও। দেখার পর কত রকমে যে তাঁকে ভেবেছি। যুদ্ধ লেগেছে। যুদ্ধে যাঁরা দেশরক্ষায় প্রাণ দিচ্ছেন, তাঁদের মায়ের কোলগুলি খালি হচ্ছে। সে কোল শুধু সেই দূর মফসসলের, গাঁয়ের মায়ের কোলটি নয়, দেশ মাতৃকার কোলও তো। এক সৈনিকের মৃত্যু এক এক মায়ের এক এক কোল খালি। দেশ যদি মাতৃস্বরূপা না হত যুদ্ধে যাওয়া সৈনিকদের ভিতরে সেই আবেগ সেই ভালোবাসা ভর করত? জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী। সংস্কৃত কত ভাবে না উচ্চারিত। শ্লোকটি কোনও না কোনও রামায়ণে উচ্চারিত, রাম ভাই লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, হে লক্ষ্মণ, এই স্বর্ণালঙ্কা আমাকে আমার জননী (Mothers Of Soldiers), আমার জন্মভূমির চেয়ে একটুও আকর্ষণ করে না। জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গেতুল্য শ্রেষ্ট।

সে ছিল এক সময়, যখন মানুষ তার জননীর সঙ্গে জন্মভূমিতেই জীবন কাটিয়ে দিত। সে যেন রামায়ণের কালের গল্প। এই যুগে যুদ্ধ বিগ্রহ, রাজনৈতিক ভাগ বাটোয়ারা, লোভ লালসায়, তা অলীকই। মানুষ যে অবিরাম উচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে নিজ দেশ, গ্রাম থেকে। সারা পৃথিবীতে জননী জন্মভূমির কোল ছাড়া মানুষের সংখ্যা অগণিত। মা (Mothers of India) অবিরাম তার সন্তান কোলে নিয়ে হাঁটছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। জাতি দাঙ্গায় হয় তা, দেশে দেশে যুদ্ধে তা হয়, আবার রাজনৈতিক পালা বদলে হয়। রাজনৈতিক পালা বদলে, মৌলবাদী ধর্মান্ধ শক্তির হাতে শাসন ক্ষমতা চলে গেলে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে অনুপ্রবেশ হয়। ভয়ে, প্রাণ বাঁচাতে, সম্ভ্রম বাঁচাতে মানুষ পালাতে থাকে অন্য দেশে। ভারতবর্ষের দেশ বিভাগ জন্মভূমি থেকে উচ্ছিন্ন করেছে যত মানুষকে, তা গত শতাব্দীতে আর হয়নি কোথাও। আমি নিজেই এক উচ্ছিন্ন পরিবারের সন্তান। দেশ বিভাগ আমাদের গ্রাম, নদী, আমাদের জন্মভূমি কেড়ে নিয়েছিল। দেশ যখন আলাদা হয়, তখন সেই জন্মভূমি শত আলোকবর্ষ দূরের হয়ে যায়। না হলে সাতক্ষীরে আর বসিরহাটে দূরত্ব তো বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার মাত্র, সে হল আলাদা দেশ, আমার দেশ নয়।

দেশ জননীকে ফেলে মা-বাবারা চলে এসেছিলেন এপারে। সেই জননী-জন্মভূমি মানে সেই গ্রাম ধূলিহর, সেই নদী বেত্রবতী (বেতনা), কপোতাক্ষ। এপারে এসে এপারটাই দেশ হল, জন্মভূমি আর হল না। আমার মায়ের সমস্ত জীবনের শোক ছিল বেতনা নদীর তীরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি আর কপোতাক্ষ তীরে তাঁর বাপের বাড়ির দুই গ্রামের জন্য। কত গল্প যে শুনেছি মায়ের কাছে। শুনতে শুনতে আমার ভিতরে সেই গ্রাম সেই নদীর জন্য আকুলতা তৈরি হয়েছে। প্রথম যেবার গিয়েছিলাম ধূলিহরে, ২০০০ সালে, আমি আমার অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। কিসের অশ্রু, কেনই বা অশ্রু, সে এক অতি সাধারণ গরিবের গ্রাম। আমার জীবনের সঙ্গে একটুও জড়িত নয়। আর আমাদের ছিল না সাত মহলা বাড়ি। মেটে ভিটে। সেই মাটির বাড়িই যেন রাজ প্রাসাদ। কে বুঝবে তার টান। যাদের নিজেদের না গিয়েছে তাদের তা বোঝার উপায় নেই। এক বন্ধু সঙ্গী লিখেছিলেন, অমরদের ভিটে বাড়ি দেখলাম, এতই অকিঞ্চিতকর যে বলার তেমন কিছু নেই। এই ধরনের কিছু। সেই অকিঞ্চিতকরই আমার কাছে অতিবৃহৎ। ছবি তুলে এনেছিলাম, মা-বাবাকে দেখাতে তাঁরা চোখের জল ফেলতে লাগলেন। মায়ের বাপের বাড়ি, আমার মামার বাড়ি বাঁকা ভবানীপুর প্রথম গিয়েছিলাম সেই ২০১৫ সালে। সেও এক হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতা। তবে সে বাড়ি ছিল মস্ত দালান কোঠা। একটিতে মায়ের জ্যাঠতুতো ভাইপো থাকে তার মাকে নিয়ে, আর একটির মালিক সেই বর্ধিষ্ণু গ্রামের শহর আলি। সেদিন তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন, তাই দেখা হয়নি। বাড়ি থেকেই কপোতাক্ষ দেখা যায়। সজল চোখে দেখেছিলাম মা রাধারানি দাঁড়িয়ে আছেন কপোতাক্ষর জলে। তাঁর সজল আঁখিই কপোতাক্ষর জল।

জন্মভূমি হারিয়ে বরিশাল থেকে উচ্ছিন্ন হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় ফেলে আসা জন্মভূমিরই কথা।

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের দেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠালছায়ায়,
হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,

এই পঙক্তিগুলি যেন হারিয়ে যাওয়া বরিশালের জন্য কবির অশ্রুজল। রূপসী বাংলা তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। যতদিন বেঁচে ছিলেন, অবিরল অশ্রুপাত করেছেন ফেলে আসা জন্মভূমির জন্য। মানুষের জন্ম একবার, জন্মভূমি একটিই। কিন্তু সেই জন্মভূমি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে যে নতুন দেশে যায় মানুষ, ধীরে ধীরে সেই দেশ সেই নগর সেই গ্রামের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়। তার সন্তানের জন্ম হয় সেখানে। এমনই জীবন। সন্তান জন্মভূমি পেল, সে হারিয়েছে তা। আমাদের এক বন্ধু লেখক তার পুরস্কার প্রাপ্তির ভাষণে বলেছিলেন, তাঁর একটা গ্রাম আছে, নদী আছে, তা নিয়ে তিনি লেখেন। একজন লেখকের নিজস্ব এমন কিছু থাকতে হয়। না থাকলে হয় না। আমি তাঁকে পরে বললাম, “তোমার তো আছে, আমার নেই, আমি আমার নেই নিয়ে কি লেখা হবে না?” তিনি জবাব দেননি।

এ তো সত্যই, তারাশঙ্করের ছিল লাভপুর। বীরভূম। না থাকলে তাঁর মহৎ উপন্যাসগুলি লিখতেন কীভাবে? বিভূতিবাবু, পথের পাঁচালী, ইছামতী তাঁর বনগাঁ, যশোর নিয়ে লিখেছেন। ভাগলপুরের ওদিকে খেলাত ঘোষদের জমিদারির নায়েব হয়ে গিয়ে বনভূমিকে দ্বিতীয় জন্মভূমি করে তুলতে পেরেছিলেন বলেই আরণ্যক লেখা হয়েছিল। সতীনাথ ভাদুড়ীর ছিল পূর্ণিয়া। আমার তো এসব নেই।
আমি আমার জীবনের অনেকটাই, তা প্রায় টানা সতের বছর কাটিয়েছি পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। এর ভিতরে অখণ্ড মেদিনীপুর জেলায় দুর্গম গ্রামাঞ্চলে কাটিয়েছি প্রায় আট বছর। আর বাঁকুড়া জেলার নানা অঞ্চলে চার বছর। আমি সেই সময় দেখতে পেয়েছিলাম যেন জননী জন্মভূমির আর এক মূর্তি। মনে পড়ে ডেবরা থানার এক গ্রামের কথা। করণ্ডা। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে করণ্ডা যাই কংসাবতী নদী পেরিয়ে দেড় ঘণ্টা কাঁচা রাস্তায় পায়ে হাঁটা। মাটির বাড়িতে ক্যাম্প অফিস। সারা গাঁটি গরিব কৃষিজীবী মানুষে ভর্তি। পাকা বাড়ি নেই বললেই হয়। সেই গ্রাম আমার কাছে আমার মা-বাবার, দাদার ধূলিহর হল। দেড়টি বছর সেখানে কীভাবে কাটিয়েছিলাম তা টের পেয়েছিলাম ক্যাম্প উঠে গেলে। দেড় ঘণ্টার রাস্তা আমি কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিলাম। সেই গ্রাম আমার জননী জন্মভূমি, স্বর্গাদপী গরিয়সী হয়ে উঠেছিল। এই যে কদিন আগে, এপ্রিলের ৬ তারিখে গেলাম বংশীধরপুর। সে কোথায়, এখনকার ঝাড়গ্রাম জেলার পশ্চিমে, গোপীবল্লভপুর থানায়। সুবর্ণরেখার তীরে। আগে মানে সেই ১৯৭৫ সালের শেষ থেকে, পুরো ১৯৭৬ সাল কেটেছিল সেই গ্রামে। এমার্জেন্সি চলছিল তখন দেশে। আর নকশালবাড়ির বিপ্লব শেষ হয়ে গিয়েছিল সদ্য। চতুর্দিকে ভয়ের আবহাওয়া। সে ছিল এক অতি দুর্গম অঞ্চল। বারিপদা যাওয়ার হাইওয়ে থেকে পায়ে হেঁটে দু’ঘন্টা। তা ব্যতীত অন্য পথ যা ছিল, তা ঘণ্টা তিন সাড়ে তিন পায়ে হাঁটা। সেই গ্রাম ফেলে আসি যখন, আবার চোখ মুছেছি। কেঁদেছি যাদের ফেলে যাচ্ছিলাম, তাদের জন্য। ১৯৭৭ সালের কথা। তারপর এত বছর, ৪৮ বছর ধরে ভেবেছি আর কি হবে দেখা? মাইকেল মধুসূদনের কথা উদ্ধৃত করি, কবিতা কপোতাক্ষ নদঃ বহুদেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে/ কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে/ দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে/ আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে…।

কবি মধুসূদনের কপোতাক্ষ, মায়ের কপোতাক্ষ আর বাঁকা ভবানীপুর, ধূলিহর, আমার সেই বংশীধরপুর। ২০২৫-এ তা দেখা হল। এখন রাস্তা হয়েছে। যাওয়া যায়। ভ্রমণকারীর জন্য হাতিবাড়ি কাছে। দেখলাম, আমাকে তারা ভোলেননি বুড়ো হয়ে যাওয়া রবিন দণ্ডপাট, চিনতে পারলেন প্রায় পঞ্চাশ বছর বাদে। বললেন, আপনি লিখতেন সন্ধেয় হ্যারিকেন জ্বেলে, মনে আছে স্যর। এই হল আমার দেশ আমার জন্মভূমি। তা রক্ষা করতে কে আছ জওয়ান হও আগুয়ান…। এই দেশের যেখানে যাই, ছ’মাস এক বছর থাকলেই, তা আমার জন্মভূমি, আমার নদী। এসব নিজের মতো করে না থাকলে কি গল্প লেখা যায়, সাহিত্য করা যায়? বন্ধু আমার সঠিক কথাই বলেছিলেন।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement