আচ্ছা, তরোয়ালের চেয়ে কলমের জোর বেশি– কথাটি কি সত্য? লিখিত শব্দের তোড়ে ভেঙে দেওয়া যায় অচলায়তনের বাঁধ? আমার সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে আমাকে যে, হ্য়াঁ, পারা যায়। কিন্তু উপান্তে এসে ধাক্কা খেলাম। এত করে যে কোভিড-বিধি মেনে চলতে বলা হল, সব পড়ে এবং জেনেও কেন বাঙালি তা অগ্রাহ্য করল? একে অশিক্ষা বলব, না, অহং? লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
“উৎসব এখন। তাই বেপরোয়া লুটব মজা। করোনা (Coronavirus) হলে ’পর ভাবা যাবে করোনার কথা”– এই হল সম্ভবত অধিকাংশ বাঙালির দিশাহারা, মত্ত, অর্বাচীন আধুনিকতা। ইংরেজি নববর্ষের নাচ-গান-জড়াজড়ি আর সমুদ্রে ডুব দেওয়ার উন্মত্ততায় বাঙালি ভাসিয়ে দিল ডাক্তারদের নিদান ও নির্দেশ, বিজ্ঞানের নিরন্তর সাবধানবাণী এবং সমাজবিদদের এই মঙ্গলকামনা যে ‘মাস্কহীন, স্যানিটাইজারহীন উৎসবে মেতে সমাজের ও পরিবারের সর্বনাশ ডেকে আনবেন না।’ এই মুহূর্তে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী এবং করোনা—গবেষকরা একমত যে, ভারতে এবং আমাদের রাজ্যে করোনার ‘তৃতীয় ঢেউ’ আর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নয়। সেই তরঙ্গ এখন আমাদের সমবেত সহায়তার সৌজন্যে, ঘটমান বর্তমান। আমরা বর্ষশেষের উৎসবে এমন ব্যাপক ও বোধবুদ্ধিহীন মাতোয়ারা না হয়ে উঠলে হয়তো করোনা আবার এমন ফুঁসে উঠে মারাত্মক রূপ নিত না। এমন কথাও বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা বলছেন, আমরা যদি করোনাকে এইভাবে ‘ডিফাই’ করতে থাকি, যদি এইভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই অতিমারী-আচরণের সমস্ত বাধানিষেধ, তাহলে তৃতীয় তরঙ্গ হয়ে উঠবে করোনা-সুনামি!
কেন এমনভাবে, এই সমাজবোধহীন, অশিক্ষিত, ভাল্গার বা অশ্লীল মত্ততায় হঠাৎ ভেসে গেল বাঙালি? কেন মাস্কের বিরুদ্ধে তারা এতটাই খেপে উঠল? কেন করোনাজনিত বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে তাদের এই যুদ্ধং দেহি ভাব? করোনার সর্বব্যাপী নাশ ও ভয়ংকরতা আমরা দু’বছর ধরে দেখছি। প্রথম যখন করোনা এল, তখন এই অতিমারীর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। এরপর চোখের সামনে দেখলাম করোনার সর্বনাশ, ভয়ংকরতা, অনিবার্যতা কোন পর্যায়ে যেতে পারে। এই ভাইরাসটিকে আমরা অনেকটাই চিনতে পেরেছি।
তা সত্ত্বেও, এখনও করোনার নতুন নতুন রূপ যে কতদূর অচেনা, অজানা দুঃসময় ডেকে আনতে পারে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে– সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই আমাদের! অর্থাৎ করোনা অসুখটির অনেকটাই জেনেছি, কিন্তু অনেকটা জানিও না এখনও। কারণ, কোভিড নিজের রূপ বদলাতে পারে। মোদ্দা কথা হল, ‘করোনা’ শব্দটি এখনও আমাদের রেখে দিয়েছে অনিশ্চিত ভয়ের দোলাচলে। তবে বিজ্ঞান এইটুকু নিশ্চিতভাবে জানাচ্ছে, করোনা থেকে সম্ভাব্য নিরাপত্তার উপায় মাস্কের ব্যবহার, করোনাবিধি বিষয়ে নিরন্তর সচেতনতা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং নিজেকে বারবার স্যানিটাইজ করার ব্যাপারে সচেতন থাকা— এই ‘বেসিক’ ব্যাপারগুলো মনে রাখতেই হবে। মনে না রাখাটা সামাজিক অপরাধ। এবং সেই অপরাধ, নৈতিক দৃষ্টিতে ক্ষমার্হ নয়।
কেন করোনাবিধি না মানা বা অর্বাচীন, বোধবিহীন আধুনিকতার তাড়নায় তা উড়িয়ে দেওয়া সামাজিক অপরাধ? এবং কেন সেই অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়? এই কারণটি নানা ব্যাখ্যায়, বিশ্লেষণে নানাভাবে বাঙালির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাঙালি তা মনে রাখেনি। কিংবা আধুনিকতার অহংকারে মানতে চায়নি সেই বাধানিষেধ বা মাস্ক পরার করজোড় অনুরোধ।
প্রশ্ন হল, যারা মাস্ক পরছে না, বা নাচ-গান-জড়াজড়ি বা কোহলমত্ত উন্মাদনায় মাতছে, তারপর বাড়ি ফিরে গিয়ে বাড়ির বৃদ্ধদের এবং শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে বহন করে আনা ‘ভাইরাল লোড’ বা ভাইরাসের ‘ভার’ বা সংক্রাম– তারা নিজেরা বেঁচে গিয়েও সমাজের এবং পরিবারের কতটা সর্বনাশ করছে, তারা কি নিজেরাই জানে না? না কি ধরে নেব জেনেশুনেই, শুধু ক্ষণিকের সুখের জন্য, নিজের মানুষদের উপরেই প্রয়োগ করছে বিষ?
রবীন্দ্রনাথের ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’ কী অব্যর্থ শ্লেষে ও কারুণ্যৈ উত্তীর্ণ হল অসংখ্য বাঙালি নারী-পুরুষের ইংরেজি নববর্ষের উন্মত্ত নৃত্য ও আলিঙ্গন-উদ্যাপনে।
ক্লাবে ক্লাবে, পার্টিতে পার্টিতে, রেস্তরাঁয় রেস্তরাঁয় বিস্মিত বিহ্বলতায় দর্শন করলাম (টিভির পরদায় অবশ্যই) বাঙালির, তথাকথিত আধুনিক বাঙালির, অশালীন, ‘আদেখলা’, মাঙ্গলিক-চেতনাহীন ‘বাকাস’ আরাধনা!
হয়তো সেই প্রাচীন গ্রিকরা, যাদের মদের দেবতা ‘বাকাস’, যাদের ‘বাকাস’ পূজা ডায়োনিসাসের মন্দিরে সত্যিই পৌঁছত ‘উর্বর’ অশালীনতায়, যে মন্দিরে পুরুষের সঙ্গে নাচ-গান আর পান করে মেয়েরা সত্যিই উর্বর হত– সেই তারাও লজ্জা পাবে ইংরেজি নববর্ষের নামে বাঙালির এই মদ্যপান উৎসবে! আর বাঙালি নারী-পুরুষ আধুনিকতার উদ্দাম দেখানেপনায় সম্পূর্ণ ভুলে গেল করোনা গত দু’বছর ধরে কী সর্বনাশ করেছে আমাদের। প্রায় প্রতি পরিবারেই মানুষ কী অসহায়ভাবে মারা গিয়েছে করোনায়। কোথায় এসে ঠেকেছে আমাদের অর্থনৈতিক নাশ! আমাদের সামাজিক অবস্থা! কী করে ক্ষণিক সুখের জন্য আমরা এত দূর স্বার্থপর হয়ে ভুলে গেলাম পরিবারের বৃদ্ধ, শিশু ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে যারা ভুগছে– তাদের কথা?
আমাদের কিছু মানুষের এক সন্ধ্যার উন্মাদনা যে হয়ে উঠতে পারে যারা বাড়িতে বসে পালন করল করোনার বিধিনিষেধ, তাদেরই বিপদ বা মৃত্যুর কারণ– এই কথাটা কি মনে রাখা এতই শক্ত! আর যারা রেস্তোরঁায়—পার্টিতে নাচ-গান করল না, মদ্যপানের মতো ‘পাপ’-কাজ করল না, কিন্তু দলে দলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ছুটল সমুদ্রসৈকতে, ডুব দিল সমুদ্রে, ভুলে গেল সমস্ত দূরত্ববিধি– তারাও কি এতটুকু কম অপরাধী? জিজ্ঞেস করুন নিজেদের।
২০২১—এর শেষ দিনে একাই ছিলাম বাড়িতে। গভীর ও বিষণ্ণ ব্যর্থতাবোধ নিয়ে। কী হবে লেখালিখি করে? কত মানুষ তো লিখেছেন বাঙালিকে ফিরিয়ে আনতে এই অর্বাচীন উন্মত্ততা থেকে সুস্থ সামাজিক বোধে! কোনও ফল হয়েছে কি? স্বয়ং সরকারও তো কখনও করেছে শাসন, কখনও অনুরোধ– বলেছে, এখনও সময় হয়নি করোনাকে উড়িয়ে দেওয়ার, মেনে চলতেই হবে করোনাবিধি! কিন্তু বাঙালি মেতেছে আত্মহননের অহেতুক তাড়নায়। একটি অব্যর্থ বই হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ‘আত্মঘাতী বাঙালী’। লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী।
সত্যিই কী অব্যর্থ দু’টি শব্দ: ‘আত্মঘাতী বাঙালী’। কে বাঁচাবে তাকে? কে-ই বা পারে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.