অতুল কুলকার্নি: ঘটনাটা যেদিন ঘটে আমি মুম্বই ছিলাম না, কাজে বাইরে ছিলাম। ফেরার পথে খবরটা পেলাম। যেহেতু টিভি দেখি না, বিভিন্ন পোর্টালে একটার পর একটা খবর আসতে লাগল। বুকিং ক্যানসেলের খবরগুলো পড়লাম। কাশ্মীর যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে দুম করে নিয়েছি, তা নয়, আসলে মনের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর কিছু চলছিল। নাশকতার ঘটনা, সন্ত্রাসবাদের ঘটনা আগেও ঘটেছে তবে এবারেরটা একেবারে আলাদা। খবরে যা দেখলাম, প্রায় সাত-আটটি প্রদেশের টুরিস্ট ছিলেন নিহতদের তালিকায়। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ আমাকে বারবার একটা কথাই বলেছেন যে, এর আগে কখনও এইভাবে পর্যটকদের ওপর হামলা হয়নি। গত কয়েক বছরে কাশ্মীরে পর্যটন ব্যবসা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। প্রতি মরশুমে একটা বড়সংখ্যক মানুষ কাশ্মীরে বেড়াতে আসছিলেন। এই পর্যটনের হাত ধরেই একটা নতুন যোগাযোগ তৈরি হচ্ছিল উপত্যকার সঙ্গে বাইরের জগতের। এবার গিয়ে আমি স্থানীয় মানুষকে এও বলতে শুনলাম যে, কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে টিউলিপ গার্ডেনে টুরিস্টের সংখ্যা প্রায় লাখ ছুঁয়েছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীরা যে বার্তা দিতে চেয়েছে, সেটা পরিষ্কার- দেশবাসি আপনারা ভয় পান, আপনারা কাশ্মীরে আসবেন না। আর সেইজন্যই ঠিক এই সময়েই কাশ্মীর যাওয়া প্রয়োজন, আতঙ্কের যে পরিবেশ এবং বার্তা তারা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে সেটাইকেই চ্যালেঞ্জ করা দরকার।
বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বসে এটাই ভাবছিলাম যে, একজন ভারতীয় নাগরিক হয়ে এই মুহূর্তে আমি ঠিক কী করতে পারি? প্র্যাকটিকালি কী করা যেতে পারে? তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম কাশ্মীর যাওয়ার। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার এজেন্ট, যে আমার খুব ভালো বন্ধুও, তাঁকে বললাম ফ্লাইটের টিকিট কাটতে। ও আমাকে প্রায় তিন বার জিজ্ঞেস করেছিল- ‘আর ইউ সিওর?’ আমার স্ত্রী গীতাঞ্জলী সেই সময়ে কাজে মুম্বইয়ের বাইরে ছিল, ওঁকে মেসেজ করে জানাতেই প্রথমটায় ও হতভম্ব হয়ে গেল। কিন্তু তিরিশ বছর আমার সঙ্গে ঘর-সংসার করার পর ও অন্তত এটুকু জানে যে, আমি এই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নিলে কিছুতেই পিছিয়ে আসব না। খুব ক্লোজ কয়েকজন ছাড়া কেউই জানত না আমি যাচ্ছি। ২৭ এপ্রিল কাশ্মীরে যাই। এখন ফিরে এসেছি।
প্রথমেই শ্রীনগরে গেলাম, সেখান থেকে সোজা পহেলগাঁও। শ্রীনগরে যে ট্যাক্সিচালক আমাকে পিক আপ করলেন, তিনি টুরিস্ট দেখে খুবই অবাক হয়েছিলেন। অল্প বয়সি এক স্থানীয় যুবক যে বোধহয় তিরিশও পার করেনি। তার সঙ্গে শ্রীনগর বা পহেলগাঁও পৌঁছে অনেকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। পরিচয় প্রকাশ করতে চাই না এই পরিসরে। এখানে সবাই খুব ভয় পেয়ে রয়েছে এবং তার চেয়েও বেশি স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখেমুখে শোক, আতঙ্কের কালো ছায়া। অমন শ্বেতশুভ্র কাশ্মীর একেবারে খাঁ খাঁ করছে। শুনছিলাম প্রায় নব্বই শতাংশ বুকিং ক্যানসেল হয়ে গিয়েছে। শ্রীনগরেও যেমন থমথমে নির্জনতা, পহেলগাঁওতেও তেমনই । কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার ছিল, এই শোকের মধ্যেও সাধারণ কাশ্মীরি মানুষদের মধ্যে একটা বিক্ষোভ এবং রাগের উদ্রেক হয়েছে। ওঁরা নিজেদের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নেমে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ভারতের অন্য যেকোনও প্রদেশে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা আর কাশ্মীরে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করার মধ্যে তফাত রয়েছে, যেকোনও মুহূর্তে যে কেউ সন্ত্রাসবাদীদের টার্গেট হয়ে যেতে পারে। এই সন্ত্রাস সাধারণ মানুষ কিছুতেই মেনে নেয়নি। আমি থাকাকলিন একটা সলিডারিটি মার্চ দেখেছি। ওখানে গিয়ে যেন মনে হচ্ছে হঠাৎ করে সবাই উপত্যকা ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে। আমার হোটেলেও গুটি কয়েক লোকজন ছিলেন। আর এমন ওখানকার অবস্থা সর্বত্র। দোকান পাট, রেস্তরাঁ, বাজার সবখানেই।
আমাকে এক প্রবীণ কাশ্মীরি বলছিলেন, “বাইশ তারিখ হর এক কাশ্মীরি খুন কে আশু রোয়া হ্যায়।” ওখানকার প্রতিটা মানুষের এই একটাই ইমোশন কাজ করছে। আসলে এই জঙ্গি হামলার কনটেক্সটটা দেখা খুব জরুরি। আমি ডেটা নিয়ে খুব সিওর নই, সেটা চেক করলেই পাওয়া যাবে। গত কয়েক বছরে যে সংখ্যক মানুষ কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছে সেটা কল্পনাতীত। প্রায় এক কোটিরও ওপরে। তাই যখন বলছি নব্বই শতাংশ বুকিং ক্যানসেল হয়েছে, সেটা কোন সংখ্যার নিরিখে সেটা ভাবা জরুরি এবং এত সংখ্যক মানুষ কেন কাশ্মীর গিয়েছে? কারণ তারা সেই আশ্বাস বা সাহসটা পেয়েছে এবং স্থানীয় কাশ্মীরিরা সেটা থেকে লাভবান হয়েছেন এবং তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাসীও বেড়েছিল। পর্যটন শিল্পের উন্নতিতে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিল। নতুন হোটেল তৈরি হচ্ছিল, অনেক মানুষের রোজগার জড়িয়ে ছিল এতে। বাইশ তারিখের পর একটা ইমেল এল, এক ধাক্কায় সব কনস্ট্রাকশনের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। আসলে আঘাতটা সেই বিশ্বাসের জায়গায়, সংহতির জায়গায়। ওখানকার অল্পবয়সিদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল, তারা বলছে, বাইশ তারিখের আগে আমাদের দম ফেলার সময় ছিল না, আর তার পর একটা মেল এল, সব কাজ বন্ধ হয়ে গেল। ওদের হতাশা আমি নিজে চোখে দেখে এসেছি। আবার এমন কিছু পর্যটকও পেলাম যারা তাদের ট্রিপ ক্যানসেল না করে চলে এসেছেন। তারা জানালেন. “আমরা আসতে পেরে খুশি এবং আমরা যে ঠিক আছি সেটা সবাইকে জানাতে চাই।” তাই আমি সকলের উদ্দেশে একটাই কথা বলতে চাই- ভয় পাবেন না। কারণ সন্ত্রাসবাদীরা চায় আমরা ভয় পাই। এটাই সময় কাশ্মীর যাওয়ার। দলে দলে যান, সন্ত্রাসের শেকল ভেঙে ফেলুন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.