শুধু ব্যাট হাতে কী করে একটা অবিশ্বাস্য স্বপ্নকে ধাওয়া করা যায় দেখিয়েছেন শচীন তেণ্ডুলকর। ক্রিকেট-ঈশ্বরের সঙ্গে কাটানো সময় তাঁকে কী শিখিয়েছে? শচীনের জন্মদিনে লিখছেন দীপ দাশগুপ্ত।
ব্যাট পুজো-১
আমরা যখন বিদেশে সফরে যেতাম, চেনাশোনা প্রচুর ভারতীয় তাঁদের বাড়ি থেকে আমাদের টিমের জন্য খাবার পাঠাতেন। সাধারণত সেই খাবার দিয়ে আমরা ডিনার করতাম। চার-পাঁচজন বসে খেতাম একসঙ্গে। কিন্তু টেস্ট ম্যাচের আগের দিন পাঠানো খাবার এলে, শচীনের আমাদের সঙ্গে খেতে বসার কোনও ব্যাপারই থাকত না। টেস্টের আগের দিন সন্ধে থেকে নিজের ঘরে ঢুকে যেত শচীন। ম্যাচে যে ব্যাটটা দিয়ে খেলবে, সেটাকে রেডি করত। ঘষত শিরীষ কাগজ দিয়ে। ডিনার নিজের রুমে আনিয়ে খেত একা একা। সেই সময় শচীন তেণ্ডুলকরকে ঘাঁটানোর দুঃসাহস আমাদের কারও ছিল না!
টিমের প্রয়োজনে প্রিয় শট বিসর্জন:
২০০৩ অস্ট্রেলিয়া সফরের কথা বলছি। সেই সফরে অস্ট্রেলিয়ার বাঁ হাতি পেসার নাথন ব্র্যাকেনের বলে সম্ভবত দু’বার কভার ড্রাইভ মারতে গিয়ে আউট হয়েছিল শচীন। তা, সেই শচীন সিডনি টেস্টে ২৪১ করল। আমি টেস্টটায় খেলছিলাম না। জল দিতে মাঠে গিয়েছি। আমাকে দেখে বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?” বললাম, কী? মুচকি হেসে শচীন বলল, “খেয়াল করিসনি যে আমি গোটা ইনিংসে একটাও কভার ড্রাইভ মারিনি!” শুনে মনে হল, তাই তো, গোটা ইনিংসে একবারও শচীনকে কভার ড্রাইভ মারতে দেখলাম না! কভার ড্রাইভ শচীনের খুব প্রিয় শট, যা ও অসম্ভব ভাল মারে। ভেবে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, শৃঙ্খলা একটা মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে? যে কভার ড্রাইভ শচীনের স্কোরিং শট, দু’বার তাতে আউট হয়েছে বলে কিনা সেই শটটাকেই ছেঁটে ফেলল টিমের প্রয়োজনে!
নার্ভাস না হলে কাজের প্রতি সৎ হওয়া যায় না:
শচীনের থেকে পাওয়া এটা একটা অদ্ভুত শিক্ষা যা সারা জীবন মনে রেখে দেব। দাদি (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) তখন ক্যাপ্টেন। ম্যাচের আগে টিম মিটিং চলছে। আচমকা টিমের কোচ জন (রাইট) বলে উঠলেন, “আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কে নার্ভাস?” নার্ভাস শব্দটাই একটু গোলমেলে। কেমন নেগেটিভ শোনায়। স্বাভাবিকভাবেই কেউ হাত তোলেনি। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম, শচীন হাত তুলে দিয়েছে! পরে অবাক ভাবে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি এটা করলে কেন? তুমি শচীন তেণ্ডুলকর, বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান, আর তুমিই কিনা ম্যাচের আগে নার্ভাস? জবাবে শচীন যা বলেছিল, গোটা জীবন ভুলব না। বলেছিল, “শোন, তুই যদি তোর কাজকে গুরুত্ব না দিস, সেটা নিয়ে না ভাবিস, তাহলে কখনওই নার্ভাস হবি না। কিন্তু যদি নার্ভ হারাস কাজ নিয়ে, বুঝবি তুই তোর কাজের প্রতি সৎ!”
চিরশ্রেষ্ঠ হয়েও মধ্যবিত্ত:
বাজারে আইপড তখন সবে এসেছে। খুব এক্সক্লুসিভ জিনিস, সবার ভাগ্যে জোটে না। একটা আইপড শচীন কিনেছিল তখন। কিন্তু সেটা নয়, মজার হল পরের অংশটা। মনে আছে, আইপড হাতে পাওয়ার পর গোটা দিন ওটা নিয়ে ও কাটিয়ে দিয়েছিল। বাচ্চাদের মতো করছিল, লোককে ডেকে ডেকে দেখাচ্ছিল। কোন বোতাম টিপলে কী হয়, শেখাচ্ছিল। কী কী নতুন গান এসেছে, শোনাচ্ছিল। আশ্চর্য হয়েছিলাম ভেবে যে, শচীন এত বড় ক্রিকেটার, ওর এত টাকা, আর সামান্য একটা আইপড নিয়ে কিনা শিশুর উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে! বুঝেছিলাম, ক্রিকেট ওকে খ্যাতি, অর্থ, নামডাক যা-ই দিয়ে থাক, ভিতরের শচীন তেণ্ডুলকরকে পালটাতে পারেনি। যে শচীন তেণ্ডুলকরের ‘সাহিত্য সহবাস’-এ বেড়ে ওঠা। যে শচীন তেণ্ডুলকর মধ্যবিত্ত মানসিকতার।
দর্শক পরে, টিম আগে:
এটা আর একটা শিক্ষা যা শচীনের থেকে আমি পেয়েছি। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নাগপুরে একটা টেস্ট চলছিল। শেষ দিন তিনশোর মতো তুলতে হত জিততে গেলে। আমি ব্যাট করছিলাম। টিম বলেছিল, গোটা দিন ব্যাট করে টেস্ট ম্যাচ ড্র করে আসতে। কারণ আগের টেস্টটা আমরা জিতেছিলাম, নাগপুর টেস্ট ড্র করলে কোনও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু দর্শকরা ভাবছিলেন যে, ভারতকে টেস্ট জিততে দেখবেন শেষ দিনে। শেষ দিকে আমার উদ্দেশে বেশ কিছু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও আসছিল। ড্রেসিংরুমে ফিরে ভেঙে পড়েছিলাম আমি। শচীনকে বলেছিলাম, আমি তো টিমের কথামতোই চলছিলাম। তাহলে আমার সঙ্গে এরকম আচরণ করল কেন লোকে? শচীন বলেছিল, “তুই যা করেছিস ঠিক করেছিস। লোকে কী বলল, সেটা শুনে চলা তোর কাজ নয়। টিম আগে, দর্শক পরে। টিম যা বলবে, সেটাই করবি।”
গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও:
শচীনের একটা বড় গুণ ছিল, যখন যেটা নিয়ে পড়বে তার একেবারে শেষ দেখে ছাড়বে। পুরো ভিতরে যাবে। ভাসা ভাসা কোনও ধারণা নিয়ে থাকবে না। মনে আছে, একবার খেতে গিয়েছি ওর সঙ্গে। গানবাজনা নিয়ে কথা বলছিল। মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টের কর্ড কীরকম হওয়া উচিত, কোনটা ভাল কোনটা খারাপ, দেখলাম সব জানে! সেদিন রাতেই আবার গাড়ি নিয়ে পড়ল। কোন গাড়িতে কী কী জিনিস করলে সেটা ভাল সার্ভিস দেবে, তা নিয়ে দেখলাম অদ্ভুত জ্ঞান। দেখে মনে হয়েছিল, লোকটা রাতদিন ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকে। তারপরেও এত কিছু বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার সময় পায় কীভাবে?
ক্রিকেটারের জাতপাত হয় না:
সব ক্রিকেটারের এই গুণটা থাকে না। অনেকেই একটা পর্যায় খেলার পর ভাবতে শুরু করে যে, আমি এত বড় জায়গায় পৌঁছেছি। সব ক্রিকেটারকে পাত্তা দেব কেন? কিন্তু শচীনের মধ্যে এই ব্যাপারটা কোনও দিন দেখিনি। যখন আমি ভারতীয় ড্রেসিংরুমে প্রথম ঢুকেছিলাম, শচীন তেণ্ডুলকরকে সামনে দেখে মনে হয়েছিল, আজ আমার ঈশ্বরদর্শন হয়ে গেল! কিন্তু সেই রাতেই মনে হয়েছিল, এই লোকটা একেবারে আমাদেরই মতো, সাধারণ মানুষ। টিমের আর পাঁচজন মেম্বারের মতোই সে থাকে। সহজভাবে সবার সঙ্গে কথা বলে, মেশে। কিছু দিন আগে মিস্টার গাভাসকরের একটা এক্সক্লুসিভ পার্টিতে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম। শচীন এসেছিল, অমিতাভ বচ্চন এসেছিলেন। সেখানে আরও বেশ কিছু ক্রিকেটার ছিল যারা হয়তো আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে বিশাল নয়। কিন্তু শচীনকে দেখলাম সবার সঙ্গে অনায়াসে কথা বলতে। আসলে ওর কাছে ক্রিকেটারের একটাই জাত- সে ক্রিকেটার। যার কোনও উঁচু-নিচু ভেদাভেদ হয় না। কোনও ক্রিকেটার আশিটা টেস্ট খেললেও শচীনের কাছে যে ব্যবহার পাবে, সমাদর পাবে, আটটা রঞ্জি খেললেও পাবে।
কোচিং কাহারে কয়:
কিছু দিন আগে মুম্বইয়ে একটা অনুষ্ঠানে শচীনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভবিষ্যতে যদি ক্রিকেট কোচিংয়ে আসতে চাই, তা হলে আমার কী কী করা উচিত? শুনেটুনে বলল, “গ্যারি কার্স্টেন হওয়ার চেষ্টা করবি!” জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? শচীন তখন বলল, “দেখ, এই পর্যায়ে এসে তুই কাউকে ক্রিকেট শেখাতে পারবি না। সব উনিশ-কুড়ি তফাত থাকবে। কিন্তু কোচিংয়ে এলে যেটা সব সময় করবি, তা হল প্লেয়ারের ভরসা জেতা। বিশ্বাস জেতা। প্লেয়ারের বিশ্বাস যদি একবার তোর উপর থেকে উঠে যায়, জানবি তুই শেষ। গ্যারির যেটা সবচেয়ে বড় গুণ ছিল। টিমের সমস্ত ক্রিকেটার বিশ্বাস করত ওকে। তাই কোচ হলে, গ্যারির মতো হবি।”
ব্যাটপুজো-২
এই গল্পটাও খুব আকর্ষণীয় লাগে আমার। শচীনের কাছে ওর ব্যাট কী, আগে বলেছি। কিন্তু একই লোকের কাছে যে শচীন ব্যাট সারাতে যায়, সেটা ক’জন জানে? মুম্বইয়ের একজন ব্যাট-সারাইয়ের লোক আছে, যাকে খেলার সময় মাঝে মাঝেই ওয়াংখেড়েতে ডেকে পাঠাত শচীন। কোন ব্যাটে কী গলদ, কী ভাবে সেটাকে সারানো যায়, সব সামনে থেকে ঠিক করাত। ওই ভদ্রলোকের বাইরে কাউকে ডাকত না। আর ব্যাট নিয়ে পাগলামি? একবার একটা সফরে এক লট ব্যাট এসেছিল ওর। দেখে সেই আইপড হাতে পাওয়ার শিশুর উল্লাস দেখেছিলাম চোখেমুখে। আমাকে বলছিল, “দেখ না তুলে দেখ কেমন? ট্রাই করে দেখ একবার?” আর তুলতে গিয়ে আমার কী হয়েছিল? থাক গে!
শচীন শুধু জানে আমার প্রথম সব কিছু:
লেখাটা শেষ করব আমার নিজের প্রথম সফর দিয়ে। আসলে জীবনের প্রথম সব কিছুর আবেগটা আলাদা হয়। তার রেশ থেকে যায় সারা জীবন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যখন নির্বাচিত হই, কে আমি? কত ভাল বোলারই বা খেলেছি? খেলার মধ্যে একবার শ্রীনাথ। একবার জাহির। ব্যস। প্রচণ্ড টেনশনে ছিলাম সফরে কী করব ভেবে। তা, ট্রেনিংয়ে একদিন অফ ছিল। কেউ যায়নি। আমি ঠিক করলাম, যাব। শচীনও দেখি বলল, “চল, আমিও যাব।” ইন্ডোরের নেটে গিয়ে একা একা ব্যাটিং প্র্যাকটিস করছিলাম বোলিং মেশিনের সামনে। শচীন পাশের নেটে। হঠাৎ দেখি ও ব্যাট করা ছেড়ে আমার নেটে চলে এল। বোলিং মেশিনের সামনে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়ে নানা রকম ইনস্ট্রাকশন দিতে শুরু করল। শচীনই আমাকে বলেছিল, “দক্ষিণ আফ্রিকায় সব সময় ব্যাটটাকে একটু তুলে রাখবি। বল পড়ে এত জোরে আসে যে অ্যাডজাস্ট করার সময় পাওয়া যায় না।” সেই সফরে ব্যাটটা তুলেই খেলেছিলাম আমি, রানও পেয়েছিলাম। শচীন রমেশ তেণ্ডুলকর তাই আমার কাছে শুধু ক্রিকেট ঈশ্বর নয়। মানুষ হিসেবেও ঈশ্বর!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.