শ্রীময়ী চট্টরাজ: আমার কাছে ৩৬৫ দিন মাদার্স ডে। আমি মনে করি, মাতৃত্ব উদযাপনের কোনও নির্দিষ্ট দিন হয় না। যেহেতু প্রথমবার মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেছি, তাই একটি বিষয় আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হল, যেদিন থেকে গর্ভে ভ্রুণের অস্তিত্ব টের পেয়েছি, সেদিন থেকেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভূত উচাটন হচ্ছিল। আমার বিশ্বাস, এই অনুভূতি প্রত্যেকটা মায়ের হয়। যেটা ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানোর মতো নয়। প্রথম যেদিন কোনও নারী জানতে পারেন তিনি মা হতে চলেছেন, তাঁর মধ্যে আবেগ-আনন্দ, উত্তেজনা, টেনশনের মতো হাজারও মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যখন সন্তানের থেকে মায়ের নাড়ির যোগ কেটে ফেলা হয়, সেই অনুভূতি অবর্ণনীয়। তাই মাদার্স ডে’র সংজ্ঞাটা আমার কাছে অন্যরকম। নাড়ির টানটাই আসল।
এত বড় হয়ে গিয়েছি আমার মা কৃষভিকে খাইয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আমাকেও খাইয়ে দেন। কাঞ্চন মাঝেমধ্যেই রসিকতা করে সেটা নিয়ে। আমার মায়ের কাছে এখনও আমি ছোট। অনেক কম বয়সে মা হয়েছি। মাতৃত্বের মাসখানেকে কাজে যোগ দিয়েছি। আর এই সবটাই সম্ভব হয়েছে আমার মায়ের জন্য। কৃষভির জীবনে ওর দিদার গুরুত্ব অপরিসীম। মা কৃষভিকে আগলে রাখেন বলেই কাজে যোগ দেওয়ার ভরসা পেয়েছি। মা সঙ্গে না থাকলে সবসময়ে হয়তো একটা অনিশ্চয়তা, চিন্তা কাজ করত। তাই আমার গোটা জীবনজুড়েই আমার মা। কৃষভিকেও এমন শিক্ষাতেই বড় করে তুলতে চাই। ওকে শেখাব, তোমার সঙ্গে মায়ের যেন বন্ধুত্বপূর্ণ। জীবনে যে কোনও বিপদে-আপদ কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যেন তৃতীয় কোনও ব্যক্তির দ্বারস্থ না হতে হয় ওকে। কৃষভি যেন ওর সব কথা উজাড় করে দিতে পারে আমার কাছে। আমি চাই, কৃষভির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হোক। অনেকেই হয়তো পারিবারিক রক্ষণশীলতার জন্য মায়ের সঙ্গে কথা ভাগ না করে নিতে পেরে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বর্তমান প্রজন্মের মা হিসেবে চাইব, কৃষভির সঙ্গে চিরকাল যেন আমার স্বচ্ছতা বজায় থাকে। মেয়েকে ছোট থেকেই শেখাব- তোমার ভুল-ঠিক যাইই হোক, বন্ধু হিসেবে মা তোমার পাশে রয়েছে। চিরকাল থাকবেও।
যে সমস্ত মায়েরা গৃহবধূ, যেমন আমার মায়ের কথাই বলছি, ৩৬৫x২৪x৭ এত সুন্দরভাবে সংসার যাপন করেছেন সব দায়দায়িত্ব সামলে, সেইজন্য মাদের তো আলাদা কোনও পারিশ্রমিক হয় না। মাদের জন্য কোনও অ্যাওয়ার্ড শো হয় না। পরের বাড়ি থেকে এসে অন্যের সংসারের হাল ধরা, এই অবদান তো কোথাও লিখে রাখা হয় না! সভ্যতা যত এগোচ্ছে, তত সম্পর্কের মর্যাদা দিতে আমরা ভুলে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে সমাজের কাছে এই লেখার মাধ্যমেই আমি একটা বার্তা দিতে চাই। সম্পর্ক আগলে রাখা শিখতে হবে। কিংবা সেই তাগিদটা যেন থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ মা-সন্তান হোক কিংবা স্বামী-স্ত্রী, সব সম্পর্কই স্পেশাল। যে মা জন্ম দিলেন, লালন করলেন, তিনি বায়োলজিক্যাল মাদার হোন কিংবা না হোন, তিনি কিন্তু তাঁর সন্তানকে কেন্দ্র করেই নিজের জীবন সাজিয়ে তুলছেন। সেই অনুভূতি একমাত্র মায়েরাই বোঝেন। কৃষভি হওয়ার পর আর পাঁচজন মায়ের মতো আমার জীবনেও বদল এসেছে। নিজের খাবার ফেলে ওকে খাইয়ে দেওয়া থেকে শুটিং থেকে মেকআপ তুলে বাড়িতে ঢোকা, অনেক বদলই আনতে হয়েছে জীবনে। বিয়ের পরও জীবন ততটা বদলায়নি, যতটা মা হওয়ার পর বদলেছে। সন্তানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করায় মাতৃ়ত্বের এক অন্যরকম আনন্দ রয়েছে। তাই সন্তানদের উদ্দেশে আমার একটাই কথা, পরবর্তীকালে কোনও তৃতীয়পক্ষের কথা শুনে নিজের গর্ভধারিণী মাকে কিংবা বাবাকে ‘বোঝা’ লাগছে বলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এলাম। তারপর ফলাও করে মাদার্স ডে, ফাদার্স ডে নিয়ে লম্বা-চওড়া পোস্ট দিলাম, এগুলো কাম্য নয়। একজন মা হিসেবে বলছি, মায়েদের চাহিদা খুব কম। খুব অল্পেতেই সন্তুষ্ট হন মায়েরা। তাই দেখনদারির থেকে বরং মাকে নিয়ে কোথাও একটা খেয়ে আসুন, সিনেমা দেখুন। একটু সময় কাটান। জিজ্ঞেস করুন- মা তুমি ভালো আছো তো? এটুকুই যথেষ্ট। টাকাপয়সা অস্থায়ী। সেদিন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘আমার বস’ ছবিটা দেখতে দেখতেই আরও একবার কথাটা মনে উঁকি দিল। কৃষভির মধ্যেও এই মূল্যবোধগুলো প্রথিত করে দেওয়ার চেষ্টা করব।
এখন দিনকাল বদলেছে। চতুর্দিকে যেরকম পরিস্থিতি, মা হিসেবে চাইব, কৃষভি প্রতিবাদী হোক। আমি তো বরাবরই স্পষ্টবাদী। সেরকমই। মানুষের মতো মানুষ হোক। অন্যায় দেখে যেন কোনওদিন চুপ করে না থাকে। মাথা উঁচু করে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। তবে সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার আগে, সমাজের অনেক মা-বাবার দৃষ্টিভঙ্গি পালটানো দরকার। বিশেষ করে তাঁদের, যাঁরা নিজের সন্তানকে হয়তো ভালো শিক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু সমান্তরালে অন্য মা-বাবাদের প্রোফাইলে কুমন্তব্যে ভরিয়ে দিচ্ছেন। মা হিসেবে আমি যেমন কৃষভির মঙ্গলকামনা করি, তেমন ওশেরও দীর্ঘায়ু কামনা করি। ও যেন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।
এবার পরিকল্পনা ছিল, মাদার্স ডে উপলক্ষে মা-দিদি পুরো পরিবারকে নিয়ে ‘আমার বস’ দেখতে যাব। আর বাইরে কোনও রেস্তরাঁয় ফিরব। যেহেতু দ্বিতীয় রবিবার তাই ছুটি। কিন্তু বাদ সাধল কনজাংটিভাইটিস। চোখ ফুলে ঢোল! এই নিয়েই চোখে বারবার ড্রপ দিয়ে শুটিং করতে হচ্ছে। তবে ভেবে রেখেছি, আমি যেতে না পারলেও টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে পাঠাব ওদের। পরে রেস্তরাঁয় যোগ দেব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.