‘আমার বস’ মুক্তির প্রাক্কালে সম্প্রতি শহরে এসে মনখোলা কথোপকথনে ধরা দিলেন প্রবীণ অভিনেত্রী রাখি গুলজার। শুনলেন শম্পালী মৌলিক।
এই গরমে কেমন আছেন?
– যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছিলাম, তখন বুঝতে পারলাম কতটা গরম। মুম্বইয়ে কিন্তু এতটা গরম এখনও পড়েনি। তাপমাত্রা বলো, কী সমস্ত পৃথিবীর অ্যাটমোস্ফিয়ারটাই তো বদলে গেছে। সমুদ্রের জল গরম হয়ে যাচ্ছে, মাছগুলো ওপরে চলে আসছে, ভূমিকম্প হচ্ছে, আগ্নেয়গিরি জাগছে, মাদার আর্থ ইজ ভেরি ভেরি অ্যাংরি।
আপনার শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি ছিল ‘শুভ মরহৎ’, ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায়।
– না, ‘বিজলিবালার মুক্তি’ করেছিলাম…
হ্যাঁ, যে ছবির পরে নাম হয়েছিল ‘নির্বাণ’। সেটার থিয়েট্রিকাল রিলিজ তো হয়নি সেভাবে।
– সেটা আমি জানি না, কী কারণ। তবে খুব সুন্দর গল্প ছিল। গল্প সুন্দর আর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলেই ছবিটা করেছিলাম। আমি এখানে রেমুনারেশনের জন্য আসি না। ‘আমার বস’-এর ক্ষেত্রেও তাই, বিষয়টা ভালো লেগেছিল। আমি সব সময় বিষয়টা দেখি। ছবিতে আউটডোর কত বেশি সেটা দেখি। আর আমি বেশি চেনা লোকদের সঙ্গে কাজ করি। হিন্দির ক্ষেত্রে বিশেষ করে। দেখবে এক-একটা প্রোডাকশনে তিন-চারটে করে কাজ করেছি।
‘আমার বস’-এর ক্ষেত্রে নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো আপনার প্রথমবার কাজ। রাজি হওয়ার কারণ কী?
– ওই যে একজনের নাম শিব, আরেক জনের নাম নন্দি। বুঝতে পেরেছ? (হাসি) আর আমার বাবা ছিলেন শিবভক্ত, পুরো পরিবারই বলতে পারো। আমার ভাইয়ের নাম শিব। ছোট ভাইয়ের নাম শঙ্কর। তার ছেলের নাম সোমনাথ। তখন ভাবলাম ‘শিব’ও সঙ্গে ‘নন্দী’ও সঙ্গে, তাহলে দেখি তো ‘প্রসাদ’টা কী? প্রসাদ হল স্ক্রিপ্ট।
আচ্ছা…
– তার আগে ওদের একটা ছবি দেখেছিলাম। ভীষণ ভালো লেগেছিল। আলাদা ধরনের, বাচ্চাদের ওপর গল্প। সেটা হল ‘হামি’। প্রত্যেকটা চরিত্র অপূর্ব। আমি শিবুকে বলেওছিলাম, হিন্দিতে কর। ‘আমার বস’-এর ক্ষেত্রে বলব বৃদ্ধ বাবা-মা যাদের বাড়িতে আছে তারা ছবিটা দেখে ডিসাইড করো কী করবে।
আপনি যশ চোপড়া, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, আরও বহু গুণিজনের সঙ্গেও। সেখানে এই নতুন যুগের হিটমেকার, এই পরিচালক-জুটির (নন্দিতা-শিবপ্রসাদ) সঙ্গে প্রথমবার কাজ করলেন…
– দেখো, আমি নতুন লোকজনের সঙ্গেও কাজ করেছি। অনিল শর্মা নতুন ছিল, তার সঙ্গে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ করেছি। হৃষীদার অ্যাসিস্ট্যান্টও নতুন ছিল। তাদের সঙ্গে কাজ করিনি, এমন নয়। পুরনোদের পাশাপাশি নতুনদের সঙ্গে করেছি। আমার মেন্টাল কমফর্ট লেভেলটা কোথায়, দেখতে হয়। সবজান্তা পরামানিক তো আমি নই। ‘নাচ না জানে অঙ্গন টেরা’ (হাসি)– সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে না? আমাকে সত্যেন বোস বলেছিলেন, কী রে ‘ঘোসলা’ (বুফো) বানিয়েছিস? আমার এত লম্বা লম্বা চুল দিয়ে ‘ঘোসলা’ বানালে কী হবে! সেই দিয়ে কোনওরকমে ম্যানেজ করেছি আমি। তাছাড়া ছবির প্রত্যেকটা গল্প। আমার গল্প পড়ার শখ ছিল। বাবাও পড়তেন। মা মারা যাওয়ার আগে, ‘দেশ’ বেরতো দুর্গাপুজোর সময়, শিবাজি পার্ক থেকে এনে দুপুরবেলায় পড়তেন। এই পড়াশোনার শখটা আমারও আছে।
এত দীর্ঘদিন ধরে মুম্বইয়ে আছেন, তার মধ্যেও বাংলা বই পড়া, ছবি দেখা, বাঙালি খাবারের প্রতি ভালোবাসা বাঁচিয়ে রেখেছেন। শুনেছি, শুটিংয়ে বাটা মাছ কিংবা মৌরলা মাছ খেতে ভালোবাসতেন। বাঙালিয়ানা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখলেন?
– বাঁচিয়ে এই জন্য রাখতে পেরেছি, কারণ অন্য জিনিসগুলো ঢুকতে দিইনি। বাইরের শখের খাবার একদিন-দু’ দিনের জন্য ঠিক আছে, রোজ কিন্তু বাড়িতেই খেতে হবে। সে কথা মাথায় রেখে খাও।
এবার কলেজ স্ট্রিট যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
– হ্যাঁ, আছে। তবে আমি যাব না, আমার চেলা আছে, যাবে। (শিবপ্রসাদকে নির্দেশ করলেন হেসে)।
আর খেতে কোথায় যাবেন?
– রাধুবাবুর দোকানে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আর ছোটবেলায় ‘চাং ওয়া’ যেতাম, টিপিক্যাল চাইনিজ খেতে। এখনও তেমন আছে কি না জানি না, গিয়ে দেখার ইচ্ছে আছে। যদি দেখি ভীষণ মডার্ন হয়ে গেছে, ভাগলবা (জোরে হেসে)।
‘আমার বস’-এ আপনি এবং শিবপ্রসাদ মা-ছেলের চরিত্রে। এই চরিত্রটাকে অ্যাপ্রোচ করলেন কীভাবে? আপনি তো আগেও অনেকবার মায়ের চরিত্রে করেছেন।
– সমস্ত মায়ের চরিত্রের প্যাটার্নগুলো আলাদা ছিল। এখানে আমার চরিত্রটা ইতিমধ্যেই সিনিয়র সিটিজেন। দ্য বয় ইজ ম্যাচিওর। ওর নিজের ভেঞ্চার আছে। এখানে মায়ের অভিযোগ ছিল যে, যদি সে অসুস্থ হয়, কেবল একজন নার্স রেখেই কি সে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারে? সেটা সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকতেই হবে। সাধারণ কথায়, পার্সোনাল টাচ ইজ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। একজন নার্সের মাথায় হাত বোলানো আর বাড়ি থেকে কেউ হাসপাতালে গিয়ে মাথায় হাত বোলালে তুমি তফাত বুঝতে পারবে।
মায়ের চরিত্র করার প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হচ্ছে। যখন আপনি চুটিয়ে হিরোইনের চরিত্রে করছেন, তারপরে মায়ের চরিত্রে ঢুকে পড়লেন– ‘বাজিগর’, ‘করণ অর্জুন’ করলেন। সেই ছবিগুলো সুপারহিট। মায়ের চরিত্রেও ভালোবাসা পেলেন কীভাবে?
– গল্প, আবার কী! যারা হিরোইন বলে আটকে বসে আছে সমস্যা তাদের। ‘তপস্যা’ একশো সপ্তাহ চলেছিল, তার মধ্যে হিরো ছিল কি? ছিল না? সেইগুলো যখন মনে করবে, দেখবে নাথিং ইজ ইমপসিবল। একদিন মা তো হতেই হয়, সেটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাও (হাসি)। তাছাড়া সুভাষ ঘাইয়ের ছবিতে মায়ের চরিত্র বা রাকেশ রোশনের ছবিতে মায়ের মূলে রাইটার কে জানো? তিনি শচীন ভৌমিক। তাঁর সঙ্গে আমার খুব ভালো জানাশোনা ছিল। ‘খলনায়ক’ থেকে আরম্ভ করে সব ওঁর লেখা। ‘রামলক্ষ্মণ’ কি ‘করণ অর্জুন’– স্টোরি লাইন কিন্তু সেই এক। শচীন ভৌমিক লেখার জোরে সেটার পুনর্জন্ম দিতে পেরেছেন।
মিস্টার বচ্চনের সঙ্গে আপনি প্রায় ১৮টি ছবি করেছেন। তার মধ্যে ১১টা ব্লকবাস্টার। কী এমন রসায়ন ছিল যে, আপনাদের জুটি ক্লিক করেছিল?
– যদিও সেটা রোমান্টিক ছিল না। ইট ডিপেন্ডস অন দ্য স্টোরি।
‘কভি কভি’ কিংবা ‘মুকাদ্দর কা সিকন্দর’ কি আর হবে…
– অ্যাক্টর দিয়ে ছবি হিট হয় না। দিলীপকুমারের ছবিও ফ্লপ করেছে। ইট ডিপেন্ডস যে, দর্শক যখন দেখতে যাবে, তারা কী ভালোবাসছে। পুরো ছবিটাই আসল। এমন কেউ নেই যাদের ছদি রসাতলে যায়নি বা দর্শক রিজেক্ট করেনি, অনেক আছে। একটা কথা জেনে রাখবে ফিল্ম ইজ অনলি ফর এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট। এই তিনটে শব্দ।
অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে যখন আপনার পর পর হিট হচ্ছে, বচ্চন পরিবারের অন্দরে নাকি আপনাকে ‘বউ রানি’ বলে ডাকা হত? সত্যি?
– (হুম) অমিতাভ যখন অমিতাভ বচ্চন ছিল না, আমাদের জানাশোনা তখন থেকে। লংওয়ে ব্যাক দেয়ার ইজ আ ফিল্ম কলড ‘রেশমা ওউর শেরা’, মরুভূমির মধ্যে শুটিং। সুনীল দত্ত ছিল প্রযোজক। অমিতাভ বচ্চন তখন কেউ ছিল না। একজন ভিলেন ছিল, রঞ্জিত, নিউ কামার। আমি ছবিটা করতে রাজি হয়েছিলাম এক সিনের জন্য, শুধু মরুভূমি দেখতে পাব বলে। তখন ‘জীবন মৃত্যু’র কাজ শুরু করে দিয়েছি।
আপনি যশ চোপড়ার ‘দাগ’-এ অভিনয় করেছিলেন, সেই ছবিতে রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুরও ছিলেন। সেই সময় শোনা যেত রাখী এবং শর্মিলা ঠাকুরের তুল্যমূল্য লড়াই। সেটা কতটা সত্যি?
– না, মিথ্যে। ওটা স্রেফ পাবলিসিটি। ছবিটাকে তোলার জন্য, এটাকে বলা যায় কাইন্ড অফ কিক। কেন ঝগড়া হবে! এসব এখনও চলে!
এখন মুম্বইয়ে দিন কেমন কাটে?
– যখন যেভাবে চাই। দ্যাট ডিপেন্ডস অন মি, মাই উইশ। আমাকে কন্ট্রোল কেউ করে না। আমিও কাউকে করি না।
খামারবাড়িতে পশু-পাখি-গাছপালা নিয়েও তো অনেকটা সময় কাটান…
– সব আছে ওখানে। সাপ, কুকুর, গাছপালা, পোকামাকড়, ৪৫টা গরু, বাবার সমস্ত আমের গাছ– এত সুন্দর জায়গা কী বলব। যে নদী বইছে, তার নাম পাতালগঙ্গা। কার না ভালো লাগবে বলো? প্রত্যেকটা গরুর আলাদা নাম আছে।
একা লাগার কোনও সম্ভাবনাই নেই তা হলে…
– একা তো আমি সারাজীবন ছিলাম। এসেছি একা, যাব একা।
নাতির সঙ্গে গল্প হয়? মানে মেঘনার ছেলের কথা জানতে চাইছি।
– আমি-ই একমাত্র, যাকে ওর পাশে শুতে দেয়। বাকি কাউকে না (হাসি)। ওকে ঠাকুরমার ঝুলি পড়িয়ে পড়িয়ে শিখিয়েছি।
প্রায় ৬০ বছরে ফিল্ম কেরিয়ার আপনার। এই দীর্ঘ যাত্রায় ‘রাখী’ বড়, না ‘রাখী গুলজার’ বড়? নিজের কী মনে হয়?
– হোয়াট ইজ দ্য ডিফারেন্স বিটুইন ‘রাখী’ অ্যান্ড ‘রাখী গুলজার?
শুরুতে আপনি ‘রাখী’, পরবর্তী কালে ‘রাখী গুলজার’।
– যারা নাম দেওয়ার তারা দেয়। আমি কাউকে কোনওদিন ইনসিস্ট করিনি। বিকজ মাই হ্যাজব্যান্ড নেম ইজ গুলজার, ন্যাচরালি আমাদের প্রথা আছে নামটা জুড়ে যায়, আদারওয়াইজ নাথিং। নেম গুলজার ডাজ নট কানেক্ট টু মাই প্রফেশন অ্যাট অল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.