‘এক মঞ্চ এক জীবন’ নাটকের দৃশ্য।
কুণাল ঘোষ: দেবশঙ্কর হালদার ক্রমশই আরও মুগ্ধ করছেন, বিস্মিত করছেন। ওঁর দেবব্রত বিশ্বাস দেখেছি, বল্লভভাই প্যাটেল দেখেছি, আরও একাধিক অভিনয় দেখেছি, কিন্তু পূর্ব পশ্চিমের ‘এক মঞ্চ এক জীবন’ নাটকে দেবশঙ্কর বাংলা অভিনয়জগতের শ্রেষ্ঠতম গিরীশ ঘোষকে উপস্থিত করলেন। দু’ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট সম্মোহিত রাখলেন তিনি অ্যাকাডেমি মঞ্চের দর্শকদের।
একের পর এক নাটকীয় দৃশ্য। আজকের আধুনিক প্রযুক্তির গ্রাফিক্সভরা সিনেমা, মুঠোফোন বা স্মার্ট টিভির সিরিয়াল বা ওটিটি সিরিজকে অনায়াসে পরাজিত করে দেয় ওই দৃশ্য: পাপবোধে মানসিক যন্ত্রণায় কাতর গিরীশের আত্মসমর্পণের মুহূর্তে তাঁর সব গরল নিজের কণ্ঠে গ্রহণ করে মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। এক গভীর বিশ্বাসে ভরা অপূর্ব রোমাঞ্চ আচ্ছন্ন করে ফেলে দর্শকদের।
আমি এই ঘরানার বেশ কিছু নাটক, ছবি দেখেছি; নিঃসন্দেহে গিরীশ ঘোষ এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের রসায়নের শ্রেষ্ঠ উপস্থাপন এখানে দেখলাম। প্রবল অবিশ্বাস থেকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, দেবশঙ্কর হালদার অসামান্য। ঠাকুরের ভূমিকায় প্রদীপ হাইত চমৎকার; খানিকটা অপ্রত্যাশিতরকম ভালো। এর জন্য নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং সম্পাদনা, নির্দেশনায় থাকা সৌমিত্র মিত্ররও কৃতিত্ব যথেষ্ট। মঞ্চে যখনই মুখোমুখি হয়েছেন গিরীশ ও রামকৃষ্ণদেব, মুহূর্তগুলি আকাশভেদী উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বাংলা নাট্যমঞ্চের কিংবদন্তি গিরীশ ঘোষকে নানাদিক থেকে কাটাছেঁড়া হয়েছে নাটকে। তাঁর ব্যক্তিজীবনের শোক, ছেলেবেলায় বাবা-মা হারানো, দুই স্ত্রী, একাধিক সন্তানের মৃত্যু, মদ্যপায়ী বিশৃঙ্খল জীবন, যা ঈশ্বরের প্রতি আস্থা হারিয়েছে; আবার নাটকের নেশায় ডুবে থাকা, অপূর্ব ফুটিয়েছেন দেবশঙ্কর। নতুন অভিনেতা কিংবা বিনোদিনী-সহ নিষিদ্ধপল্লি থেকে আসা অভিনেত্রীদের অভিনয় শেখানোর পর্ব দেখে হলে বসেই মনে হচ্ছিল দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয়ের ওয়ার্কশপে বসে আছি। সংলাপের সঙ্গে মানানসই প্রতিহিংসার হাসি কীভাবে হয়, এমন প্রাণবন্ত দৃশ্য মঞ্চে ভারি সুন্দর নামিয়েছেন ওঁরা।
গিরীশের ভেতরের নানা দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক দলিলের মতো ফুটে উঠেছে। ভালো নাটক তৈরির ইচ্ছে, আবার উল্টোদিকে টিকিট বিক্রি করে নাটক বাঁচাতে চটুল জনপ্রিয় চিত্রনাট্য লেখার বাধ্যবাধকতা, স্রষ্টার এই নিজের ভেতরে সংঘাত, দেবশঙ্কর মুখ আর মুখোশের সমীকরণটা দর্শককে হৃদয় ছুঁয়ে বুঝিয়েছেন। গিরীশবাবুর জীবনটাও যে একটা সংগ্রাম, তাঁর চিন্তাও যে নবজাগরণের পতাকাবাহী, আপসের মধ্যেও তিনি যে সমাজের নেতিবাচকতাকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার পক্ষে, নাটকের এই ধারাভাষ্যের অভিমুখ সঠিক। জেদ, ঔদ্ধত্য বনাম অসহায়তা; উদ্দাম হুঙ্কার বনাম ‘জুড়াইতে চাই’ গানের আড়ালে আর্তনাদ, এই বিপরীতমুখিনতার সহাবস্থান এই নাটকের অলঙ্কার। গিরীশ, বিনোদিনীকে কেন্দ্র করে আরও দুটো আঙ্গিক এই নাটকে উল্লেখযোগ্য।
বিনোদিনীর জীবনের ভাঙচুর তো বহুচর্চিত। কিন্তু যে অংশগুলি সেভাবে সামনে আনা হয় না, সেগুলি এই মঞ্চে এসেছে। এক, গিরীশ ঘোষের সঙ্গে বিনোদিনীর সম্পর্কটা শুধুই গুরুশিষ্যার, নাকি প্রেমের টান কখনও ছিল। দুই, বিনোদিনী যখন মধ্যগগনে, তখন তারাসুন্দরী বা তিনকড়িদের মতো নতুনদের উত্থানে ঈর্ষাজনিত কারণে তিনি বাধা দিতেন কি না? কার চরিত্র কতবার হাততালি পাচ্ছে দর্শকের, সেই তুলনা করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমূলে উৎপাটনের প্রবণতা তাঁর মধ্যে ছিল কি না। এর পাশাপাশি বিনোদিনী থিয়েটারের বদলে স্টার থিয়েটার নামকরণে বিনোদিনীর হতাশা এবং গিরীশবাবুর বাধ্যবাধকতার চাপে এই অবিচারের হয়ে ওকালতির সূক্ষ্ম রেখাটাও নাটকে ধরা হয়েছে যথাযথভাবে। বিনোদিনীর ভূমিকায় ঝুলন ভট্টাচার্য সুন্দর অভিনয় করেছেন। তিনকড়িতে সিলভিয়া চমৎকার। অমৃতলাল চরিত্রে অমিত দেব মানাসই। অভিনয়ের বাকিরাও ঠিকঠাক সুর বেঁধে রেখেছেন। গানের প্রয়োগের চেষ্টা ভালো। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও গিরীশ ঘোষের ‘রাম রহিম না জুদা করো’ যখন মঞ্চে গাওয়া হয়, বোঝা যায় লেখকের শুধু কলম ছিল না, সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি ছিল যা যুগের সীমাকে অতিক্রম করেছে অনায়াসেই।
নাটকের শুরু থেকে শেষ, গিরীশ ঘোষের ভূমিকায় দেবশঙ্কর যেভাবে চুম্বক হয়ে থেকেছেন, তা অবিশ্বাস্য। কাউকে ছোট না করে বলতে পারি, এমন অভিনেতা বাংলায় আর কোথায়? মঞ্চে চোখের সামনে একটা জীবন্ত মানুষ নিজেকে এতরকম আবেগে ভাঙচুর করছে, এটা একদম আলাদা অভিজ্ঞতা। সিনেমা, সিরিয়াল, সিরিজ, শুটিং, রেকর্ডিং, সম্পাদনা, যন্ত্র, গ্রাফিক্সের বাইরে লাইভ পারফরম্যান্স। বর্তমান মুহূর্তটাই শেষ কথা। এই অভিনয়শিল্পটিকে দেবশঙ্কর যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, বাংলা দর্শকসমাজ, মিডিয়া, মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং তার যথাযথ স্বীকৃতি দিয়েছে বলে আমি মনে করি না। মানুষটার মস্তিষ্ক গবেষণার যোগ্য। একসঙ্গে সাত-আটটা নাটক করতে পারেন, হয়তো বেশি। তিনটের শোতে একটি চরিত্র, সাড়ে ছটায় আরেকটি চরিত্র। বিরলতম ক্ষমতা। আমি ব্রাত্য বসুর নাটকের ভক্ত। আর সেই সঙ্গে অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদারের। কেন দেবশঙ্করকে সুপারস্টার বলা হবে না? তথাকথিত গ্ল্যামার কেন মঞ্চের মহাতারকাকে আলোকিত রাখবে না? যত সহজে সিনেমা, সিরিয়ালে প্রচার, পরিচিতি পাওয়া যায়, মঞ্চ কেন বহুযোজন দূরে থাকবে, দর্শকদেরও ভাবতে হবে।
আপাতত, এই ‘এক মঞ্চ এক জীবন’ দেখার পর এই সাধারণ দর্শকের অনুভূতি এবং পরামর্শ, দেবশঙ্করের মধ্যে খোদ গিরীশ ঘোষ ভর করে আছেন, এই দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে নাটকের পরের শো, শততম প্রদর্শনটি দেখে আসুন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.