আকাশ মিশ্র: জীবন মানে কী? ভালো ভালো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে চলা নাকি ফের অতীতের সমুদ্রে ডুব দিয়ে সেই মুক্তো ধরে আনা, যা আসলে বেঁচে থাকার পরশপাথর! আসলে, জীবন চলতে চলতে আমরা যা ছেড়ে আসি, তা অনেক সময়ই অনিচ্ছায় কিংবা কোনও উপায় না পেয়েই। ঠিক যেমন উত্তর কলকাতার সেই বড় ছাদওয়ালা বাড়িটা। উত্তর কলকাতার সেই ইটের পাঁজর বের করা দালান। যার চিলাকোঠায় এক সময় আড্ডা বসত চায়ের সঙ্গে। বিশ্বকর্মা পুজোয় যে বাড়ির ছাদে চলত ভোঁকাট্টা উল্লাস। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার মাঝে টিকটিকি, আরশোলার নিত্য যাওয়া আসা। সেই বাড়িটাকে কী আঁকড়ে ধরে রাখা গেল? সেই বাড়ির অন্দরে একান্নবর্তী পরিবার কি ধরে রাখা গেল? নাকি চেষ্টাই করা হল না, সেই ছড়িয়ে যাওয়া পরিবারকে একত্র করার। পরিচালক মানসী সিনহার দ্বিতীয় ছবি ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’, এই প্রত্যেকটি বিষয়েই প্রশ্ন তোলে এবং উত্তরও খোঁজে। এক প্রজন্মের থেকে আরেক প্রজন্ম পেরিয়ে উত্তর কলকাতার সেই শরিকি বাড়ি যেন, এই প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে পরিবারের বন্ধনকে। সম্পর্কের অর্থকে। ডিভোর্স, একাকী জীবন, বিদেশে চলে যাওয়া বাড়ির ছেলেটি, বৃদ্ধ মা-বাবার এক চিলতে সংসার যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছে নতুন প্রজন্মের জীবনে, তার দিকে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এই ছবি। বলা ভালো, স্বপ্ন দেখায়, যে এমনটা হতেই পারে!
‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’ ছবির গল্পটাও এই প্রবাহেই এগিয়ে চলে। যেখানে পরিবারের বড় ছেলের মৃত্যু, পরিবারের ভাঙন, সর্বপরি পৈতৃকবাড়ি ছেড়ে এসে আলাদা আলাদা দেশলাই কাঠির বাক্সের মতো ফ্ল্যাটে বসতি। কেউ খোঁজ রাখে, কেউ খোঁজও রাখে না এক শহরে থেকেও। আর সেই খোঁজের মাঝেই নিখোঁজ হওয়া ঠিকানায় ফের ফিরতে চায় এই প্রজন্মের দুই নাতনি। সঙ্গী তাঁদের হবু বর এবং শ্বশুরবাড়ি।
মানসী সিনহার এই ছবির গল্প হয়তো আগেও দেখেছি আমরা। তবে মানসীর মুন্সিয়ানায় এই ছবি একেবারেই নতুন লাগে। কেমন যেন পুরনো বাড়ির সেই আদরমাখা গন্ধকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। যেখানে অনবরত সেই মানুষদের আনাগোণা, যাঁরা একসময় ফুলকাকা, ফুলকাকি, নজেঠ্যু, পিসিমণি, মাসিমণি নামে ঘুরে বেড়াত। সেই আত্মার বন্ধনকে যেন ফের শক্ত করলেন মানসী। আর ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’কে রূপক হিসেবে রেখে পরিবারের মূল্যবোধ, আবেগকে ইটপাথর এবং মার্কেটিংয়ের এই জগতে নিয়ে এসে ফেললেন। ঠিক যেন সকালের স্বপ্নের মতো। যা দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, যে একদিন এই স্বপ্ন সত্যি হবে।
মানসীর এই ছবিতে রয়েছে এক ঝাঁক নতুন মুখ। যেমন, অন্বেষা হাজরা. পায়েল মুখোপাধ্যায়। রয়েছেন অপরাজিতা আঢ্য, চন্দন সেন, খরাজ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুণী মুখোপাধ্যায়, অর্জুন চক্রবর্তীর মতো পটু অভিনেতারাও। যাঁরা নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। তবুও বলতে হয়, এই ছবির আসল নায়কই হল চিত্রনাট্য। প্রতিটি দৃশ্য খুবই যত্ন করে বানিয়েছেন যে মানসী, আর তা স্পষ্ট প্রতিটি ফ্রেমে। হইচই, মারাকাটারি ছবির ভিড়ে মানসীর ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’ যে মনকে স্বস্তি দেয়, তা বলাই বাহুল্য। এই ছবি দেখে হল থেকে বেরিয়ে এক অদ্ভুত তৃপ্তি পাবেন। এই তৃপ্তি পরিবারকে আঁকড়ে ধরে রাখার। এই তৃপ্তি সুখস্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে চলার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.