নির্মল ধর: পরিচালক হওয়ার আগে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের (Anindya Chatterjee) প্রথম পরিচিতি ‘চন্দ্রবিন্দু’র গীতিকার-গায়ক হিসেবে। আরও একটু পরে ঝরঝরে ফুরফুরে কলমচির। তাঁর কলমে যেমন শব্দের খেলা চলে, চলে ব্যঙ্গ, তেমনই আবার থাকে বিদ্রুপের পিন ফোটানোর মিষ্টি আরাম। সিনেমাতেও সেই ধারা বজায় রয়েছে। নিজেরই লেখা ‘বকলস’ উপন্যাস নিয়ে তৈরি ‘প্রেম টেম’ (Prem Tame) ছবিতে আজকের কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীর ভালবাসা, খুনসুটি, চুমু, বিদ্রোহ, সংগীত প্রেম, প্রথাবিরোধী হয়ে ওঠার জন্য প্রতিবাদের সঙ্গে নির্বাক এক পোষ্যকে আপন করে নেওয়ার গল্পকে সাজিয়ে তুলেছেন। সেই সাজানোর মধ্যেও অনিন্দ্য তাঁর নিজস্বতায় জড়িয়ে দিয়েছেন সংলাপের করিকুরি। ‘মেঘদূত’-এর লেখক কালিদাস নাকি ‘আদিদাস’, কলেজে অধ্যক্ষের মুখে ফ্রেশার ও প্রেসার, সোশ্যাল-অ্যান্টিসোশ্যাল নিয়ে সংলাপের জাগলারি এখনকার জেনারেশন এনজয় করবেই। তাঁর এ ছবির সংখ্যাগুরু দর্শক তো তারাই।
পাবলো নামের তরুণ কলেজে ঢোকার আগে প্রেম করেনি। চুমু পর্যন্ত খায়নি। কিন্তু সহপাঠী আরশির সঙ্গে কিঞ্চিৎ বন্ধুত্ব হতে না হতেই বেয়াড়া পরিবেশে চুমু খেতে গিয়েই কলেজে মস্তানদের হতে ক্যাচ কট কট! সুতরাং ছ’মাসের জন্য সাসপেন্ড। আরশিকে পাঠানো হয় মামাবাড়ি। আর কলেজে প্রতিবাদ আন্দোলন করে সাসপেন্স তোলার পাশাপাশি পাবলো গেঁথে ফেলে রিসার্চ স্কলার রাজেন্দ্রাণী ওরফে রাজিকে। ব্যস, দু’জনের লিভ-ইন সম্পর্ক এর শুরু। রাজি আবার সঙ্গে নিয়ে আসে তার সারমেয় সন্তান খগেনকে। আরশি হাওয়া! অতি আধুনিক রাজির কাণ্ডকারখানা দেখে সারাক্ষণ হনুমান চল্লিশা পড়া মা ঘর বাড়ি ছাড়েন। তারপর শুরু হয় পাবলো আর রাজির নতুন সংসার। কিন্তু সেখানেও খগেনের সর্বক্ষণ উপস্থিতি দুজনকে ‘প্রেমটেম’ করতেই দেয় না। তাও মানিয়ে নিচ্ছিল পাবলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাজি উধাও। সে কোনও বন্ধনে থাকতে চায় না। খাগেনকে পাবলোর জিম্মায় রেখে হয়ে যায় নিরুদ্দেশ। খগেনকে নিয়ে জেরবার পাবলোর জীবনে আবার ফিরে আসে আরশি। কিন্তু সেও জানিয়ে দেয় ওদের জীবন থেকে খগেনকে ‘ডিলিট’ করতে হবে। এখানে এসেই গল্প অন্য মোড় নেয়। এবং দর্শক কিছুটা ক্লান্ত হয় খগেন-পাবলোর ভালবাসা ও লুকোচুরির দীর্ঘ খেলায়। খাগেন ফিরে এলেও আরশি আসবে কি আসবে না? সেটা এক ‘সাঁকো’র রহস্যে লুকিয়ে রাখেন পরিচালক। জীবনকে ভালবাসাটাই মুখ্য, ‘প্রেম টেম’ গৌণ। সুতরাং ভ্যালেন্টাইনস ডে’র (Valentine’s Day) ছবি হতে গিয়েও হয়ে উঠল প্রেমের এক বিশাল পরিধির জয়গান।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এমন সিরিয়াস উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য এতো লঘু পথটি কি উপযুক্ত? (হ্যাঁ, চ্যাপলিনের ছবির কথা মনে রেখেই বলছি) ছবির সমাপ্তির এই ভারটুকু সরিয়ে রাখলে, ‘প্রেম টেম’ মুচমুচে, মজাদার, চেটেপুটে খাবার মতো ছবি। যে ধরনের সিনেমা তৈরি করতে বেশ ভালই পারেন অনিন্দ্য। আর যে জন্য অনুপম রায়কে (Anupam Roy) দিয়ে কলেজ ফেস্টে গাইয়েছেন “আমায় এনে দে জল ফড়িং” গানটি। আবার নিজে গেয়েছেন “তোমার তো কাছে মরে বেঁচে আছি”র মতো জনপ্রিয় গানগুলো। পাবলো এবং রাজির জীবনে বাবাকে হারানো, বা রাজির লুকোনো কোনও দুঃখ শোক সরিয়ে জীবনের আনন্দকে উপভোগ করার কথা বলতে চেয়েছে ছবিটি। কিন্তু সেখানেই ছবির স্ট্রাকচার ঠিক মেলেনি। যাঁরা ভ্যালেন্টাইনস ডে সেলিব্রেট করতে এই ছবি দেখবেন জোড়ায় জোড়ায় বসে, তাঁদের কাছে ‘প্রেম টেম’ ক্লান্তিকর নাও লাগতে পারে।
তিনজন আনকোরা অভিনেতা নিয়ে অনিন্দ্যর পরীক্ষামূলক কাজটির অবশ্যই প্রশংসা করতেই হয়। বিশেষ করে টমবয় রাজির চরিত্রে সুস্মিতার (Susmita)। সৌম্যর পাবলো শুধু চলেবেল। আরশির ভূমিকায় শ্বেতা বরং তুলনামূলক ভাল। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ বেশ কয়েক জায়গায় একটু লাউড। গানের সুরে শান্তনু মৈত্র (বিশেষ করে মন্দিরে হিন্দি গানটি) পাক্কা মজারু। আর ভালো লাগে চন্দননগর, হুগলি, শ্রীরামপুর এলাকার সুন্দর লোকেশনগুলোর ব্যবহার। অনিন্দ্য নিজের কণ্ঠে শুধু পাবলোর পরিচিতিই দেননি, খগেনের নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়ে গল্পকে এগিয়েও নিয়েছেন। সেখানেও মিশে রয়েছে তাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গির কমিক টেকনিক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.