শচীন, বিশ্বব্যাপী ভারতীয়রা আপনাদের তিনজনের জন্য পৃথক একটা শ্রেণিবিভাগ করে নিয়েছেন।
শচীন: আমরা তিনজন মানে?
আপনি, অমিতাভ বচ্চন আর লতা মঙ্গেশকর।
শচীন: কী বলছেন? ওঁরা দু’জন বলুন। আমি মোটেও অমিতাভজি আর লতা মঙ্গেশকরের পাশে বসার যোগ্য নই।
বিনয় করবেন না প্লিজ।
শচীন: সত্যি বলছি। কী অবিশ্বাস্য দু’জন মানুষ সম্পর্কে কথা বলছেন দেখুন। একজন লতাজি–ছোটবেলা থেকে যাঁর গান শুনে আমি বড় হয়েছি। আর একজন অমিতজি। সিনেমা দেখার বয়স হতে না হতেই আমি যাঁর মায়াজালের খপ্পরে। আমার জীবনের একটা বিশাল সৌভাগ্য হল এই যে এমন দু’জনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি। চিনি।
ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে কী শিখেছেন অমিতাভ বচ্চনের কাছে?
শচীন: শিখেছি চূড়ান্ত সাফল্যেও কীভাবে নম্র, ভদ্র থাকতে হয়। আমার বাবা ছোটবেলা থেকে যে সব ভ্যালুজের কথা বলতেন সেটা আমি অমিতজির মধ্যে দেখি। বিস্ফারিত হয়ে দেখার মতো আর একটা জিনিস হল ওঁর লংজিভিটি। স্থায়িত্বটা ভাবুন! এত এত বছর ধরে নিজের পেশার শীর্ষে। আরও একটা আশ্চর্য জিনিস হল যা অ্যাচিভ করেছেন তা নিয়ে কখনও তৃপ্ত নন। নিজেকে রগড়েই যান। রগড়েই যান। আর নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে নতুন নতুন সময়ে নিয়ে ফেলেন। এই যে এবিলিটি টু রি ইনভেন্ট–এটাই আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করে।
আপনার সঙ্গে ওঁর আলাপ কবে থেকে?
শচীন: যতদূর মনে পড়ছে ১৯৯৩। ইন্ডিয়ান টিম দিল্লিতে একটা ডিনারে নিমন্ত্রিত ছিল। সেখানে উনিও ইনভাইটেড ছিলেন।
১৯৯৩ মানে তো ততদিনে আপনি তেণ্ডুলকর হয়ে গিয়েছেন!
শচীন: (যেন শুনতে পাননি) অমিতজি এলেন। এসে নিজে থেকে খুব প্রশংসা করলেন। উৎসাহ দিলেন। সেই গুড উইশেসটা আমি আজীবন ভুলব না। কেননা ওটা স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনের কাছ থেকে এসেছিল। দারুণ ইনস্পায়ারও করেছিল।
কবে থেকে দেখছেন ওঁর ছবি?
শচীন: যখন আমার আট-ন’বছর বয়স। সেই সময় ওইসব অ্যাকশন প্যাকড, অ্যাগ্রেসিভ ফিল্মগুলো দেখতে দারুণ লাগত।
মানে টিন এজ-এ পড়ছি পড়ছি সময়টা আপনাকে গ্রাস করে নিল দু’রকম অ্যাগ্রেশন। টেনিস কোর্টে জন ম্যাকেনরো। সিলভার স্ক্রিন-এ অমিতাভ বচ্চন।
শচীন: আসলে ওই বয়সে বাচ্চারা এসব জিনিসের প্রতি দুমদাম আকৃষ্ট হয়। তখন তো অত বোঝার বয়স থাকে না। অ্যাট্রাকশনটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। এখন যেমন ওদের জীবনে ডব্লু ডব্লু ই। ডিফারেন্ট স্টেজেজ অফ লাইফ—এ মানুষ ডিফারেন্ট জিনিসের সমাদর করতে শেখে। তার পছন্দগুলো বদলে বদলে যায়। একটা বয়সে অ্যাগ্রেশন দেখে মুগ্ধ হতাম। পরবর্তীকালে ভাবনাটা অন্য খাতে বইতে শুরু করে। তখন ভাবতে শুরু করে, স্কিলটা কী পর্যায়ের ছিল যে এই জিনিসটা করে দেখাতে পেরেছিলেন!
আপনার বাড়িতে শুনেছি সবাই দেবানন্দের খুব ভক্ত ছিলেন।
শচীন: হ্যাঁ, পুরো বাড়ি। বিশেষ করে আমার বাবা।
কীর্তি কলেজে নাকি অনেকে আপনার বাবাকে দেব সাব বলে ডাকত?
শচীন: হাঃ হাঃ। একদম তাই। আসলে কতগুলো অ্যাঙ্গল থেকে চুল আঁচড়ালে আমার বাবাকে অবিকল দেবসাবের মতো দেখাত। কিছু ছবিও রয়েছে যেগুলো আমি দেখেছি।
সেই দেব আসক্ত সংসার থেকে আপনি বিধর্মী হয়ে যোগ দিলেন বচ্চন ক্যাম্পে?
শচীন: আমার বেড়ে ওঠার সময় তো শুধুই ওঁর ছবি দেখতাম। আর শুধু কী অ্যাকশন নাকি? অমিতজি তো সব কিছু করতেন। ট্র্যাজেডি, কমেডি, রোমান্টিক। একটা সময় আমি ভাবতে শুরু করি একজন অভিনেতা আর ক্রিকেটারের মধ্যে বেসিক গুণের কী তফাত? তারপর মনে হতে থাকে বেশির ভাগ জিনিসই তো এক। পরিশ্রম, সংকল্প, অধ্যবসায়, দূরদৃষ্টি।
বেশ কিছু বছর ধরে আপনি বচ্চন পরিবারের ঘনিষ্ঠ। ওঁর কোন গুণটা আপনাকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করে?
শচীন: নিজেকে বারবার নতুন করে পরিবেশনের ঝোঁক। ওঁর চরিত্রের এই জোশটা আমার দারুণ লাগে। এমন নয় যে উনি জীবন থেকে অতৃপ্ত। বা অনেক কিছু পাননি বলে ঝাঁপাতে চাইছেন। আমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগে, যে উনি হ্যাপি অথচ হাংরি। জিনিয়াসদের পক্ষেই সম্ভব!
ইউটিউবে গেলে একটা পোস্ট দেখা যায় যেখানে লতা পারফর্ম করছেন। আর মাঝখানে ‘সিলসিলা’ গাইবার সময় ডেকে আনলেন অমিতাভকে। ‘ইয়ে কঁহা আ গয়ে হাম’—এর সঙ্গে ডায়ালগ বললেন অমিতাভ। দর্শকাসনে রেখার একটু দূরে বসা আপনি আর অঞ্জলি।
শচীন: ইয়েস, ইয়েস। ওটা বেশ অনেক বছর আগে। রাজ ঠাকরে অর্গানাইজ করেছিল। সেই প্রথম আমি ওঁদের দু’জনকে একসঙ্গে পারফর্ম করতে দেখি। দ্যাট ওয়াজ দ্য আলটিমেট। আমার প্রায় লোম খাড়া হয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল চোখের সামনে ‘সিলসিলা’ দেখছি।
কোন বচ্চন ফিল্ম আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
শচীন: ‘শোলে।’
কেন ‘শোলে’ তো মাল্টিস্টারার। অনেকে ছিলেন?
শচীন: তাতে কী হয়েছে, অমিতজি খুব সিগনিফিক্যান্ট রোলে ছিলেন। সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট।
আর?
শচীন: ওঁর করা এত এত ফিল্ম আমার প্রিয় যে একটা বেছে নেওয়া খুব কঠিন। তবু বেশ কয়েকবার দেখেছি ‘অগ্নিপথ।’ কেবিসি-তে যখন প্রথমবার যাই এই আবদারটা করি, সেই ডায়ালগটা বলে শোনাতে হবে ‘ম্যায় বিজয় দীননাথ চৌহান। গাও মান্ডওয়া। মা-কা নাম সুহাসিনী চৌহান।’
‘পিঙ্ক’ দেখেছেন?
শচীন: হ্যাঁ।
‘পিকু’?
শচীন:অফ কোর্স।
আপনি তো দেখছি বচ্চন ফ্যান বয়?
শচীন: কে নয়, আমায় বলুন তো।
মাইল ফলক জন্মদিনে বিশেষ শুভেচ্ছা কিছু জানাতে চান আপনার অমিতজিকে?
শচীন:আমার উইশ গুড হেলথ আর হ্যাপিনেসের জন্য। অমিতজি সুস্থ থাকুন। হ্যাপি থাকুন।
এমন কিছু আছে যা ওর জীবন থেকে নিয়ে নিজের ক্রিকেটে মিশিয়েছেন?
শচীন: সে তো থাকেই। দৌড়তে দৌড়তে সামান্য ক্লান্ত হয়ে পড়া মানুষ তবু অ্যাচিভারদের থেকে শেখে। জ্বালানি ভরে। আবার দৌড়য়। আমি অমিতজির ক্রমাগত প্যাশন থেকে শিখেছি ভালবাসার জিনিসকে টানা বয়ে নিয়ে যাওয়া। খিদেটাকে অক্ষত রাখা। ওঁর প্যাশনটা অবিশ্বাস্য!
ইডেনে গতবছর ভারত-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সময় একটা অদ্ভুত দৃশ্যকল্প তৈরি হয় যখন ইন্ডিয়া জেতার পর আপনি আর বচ্চন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জনে জাতীয় পতাকা দোলাচ্ছিলেন। কিছু পরে মুকেশ আম্বানি যোগ দিলেন সেখানে।
শচীন: ইয়েস। আমরা লাস্ট অবধি পাশাপাশি বসে ম্যাচ দেখছিলাম।
ব্লগ—এ মুগ্ধ অমিতাভ লিখেছেন, আপনি নাকি প্রতি মিনিটে মিনিটে ম্যাচের আগাম ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন যে এখুনি কী ঘটতে যাচ্ছে? স্ট্রোকটা কোথায় খেলা হবে? ম্যাচ কোন দিকে এগোবে? আর সেগুলো নাকি অব্যর্থ প্রেডিকশন ছিল।
শচীন: ইয়েস। এটা আমার অভ্যেস। খেলা চলাকালীন আমি বলতে থাকি ঠিক এরপর কী হতে যাচ্ছে? এই স্ট্রোকটায় কত রান হতে পারে (হাসি)? সেদিন সেগুলো মিলে গেছিল এই আর কী (হাসি)।
বচ্চন পরিবারকে এত কাছ থেকে দেখেছেন। ওঁদের বৈশিষ্ট্য কী?
শচীন: বৈশিষ্ট্য ওঁরা খুব ক্লোজ নিট পরিবার। খুব ডিসিপ্লিনড। ভদ্র সৌম্য। আর মানুষের প্রতি খুব শ্রদ্ধাবনত। আমাকে ওঁরা খুব রেসপেক্ট দিয়ে বরাবর ট্রিট করেছেন।
কাম অন শচীন। আপনাকে রেসপেক্ট দেওয়া থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না। শচীন তেণ্ডুলকরকে কে রেসপেক্ট দেবে না?
শচীন: না, না। কে সত্যি ভেতর থেকে রেসপেক্ট দিচ্ছে সেটা মানুষের ব্যবহারে বোঝা যায়। ওঁরা সত্যি অন্যরকম ঘরানা। বললাম না আমার বাবা ঠিক এইরকম কৃষ্টি আর সভ্যতার কথাই বলতেন।
আর ধরে রাখব না আপনাকে। লাস্ট প্রশ্ন, এতদিনের মেলামেশায় একটা মজার মুহূর্ত বলুন।
শচীন: মজার মুহূর্ত? উ উ উ। ওকে একটা কথা এখুনি মনে পড়ছে।
বলুন।
শচীন: পেপসির শুটিং করছি আমরা দু’জন। অনেক বছর আগের কথা। অর্জুনের বয়স তখন দেড় বছর। বুঝতেই পারছেন কত আগের কথা। ও আমার আর অমিতজির মধ্যিখানে কোলে বসে আছে। ব্রেক-এ আমাদের কমলা দিয়েছিল। অর্জুন খেয়েটেয়ে স্ট্রেট অমিতজির কুর্তায় হাতটা মুছে নিল। দৃশ্যটা দেখার পর লজ্জায় আমি কোথায় লুকোব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.