সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: অসম, মেঘালয় অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব ভারতের ফসল স্কোয়াশ ফলছে পশ্চিমাঞ্চলের রুখা মাটিতেও। তাও আবার পুরুলিয়ার মতো পতিত জমিতে! মাটির সৃষ্টি প্রকল্পে পুরুলিয়া ১ নম্বর ব্লকের ভান্ডারপুয়ারা-চিপিদা গ্রাম পঞ্চায়েতের রালিবেড়াতে এই ফসলের ফলনে তাক লেগে গিয়েছে কৃষক মহলে। একেকটি স্কোয়াশের ওজন ১কেজি ১০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ৭০০ গ্রাম পর্যন্ত। পুরুলিয়া ১ ব্লক কৃষি দপ্তর বলছে, সাধারণভাবে ১২০০ থেকে ১৫০০ গ্রামের বেশি এই ফসল হয় না। খরা কবলিত পুরুলিয়ার মাটিতে স্কোয়াশ ১ কেজি ৭০০ গ্রাম ফলন হওয়ায় এই চাষের ক্ষেত্র বাড়াতে পরিকল্পনা নিয়েছে কৃষি দপ্তর। সেই সঙ্গে বিপণনের বিষয়টিও দেখছেন তারা। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের আওতায় থাকা সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের মধ্য দিয়ে এই ফসলের বিপণনের দরজা খোলার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে।
হঠাৎ করে জঙ্গলমহলের এই জেলার পতিত জমিতে স্কোয়াশ চাষ কেন? পুরুলিয়া এক ব্লকের সহ কৃষি- অধিকর্তা তন্ময় সাহা বলেন, “মাটির সৃষ্টি প্রকল্পে চাষাবাদের উদ্দেশ্যই ছিল পতিত জমিতে চাষ করে অনুর্বর জমিকে উর্বর করে তোলা। তাই রালিবেড়া এলাকায় কৃষকরা টমেটো, ঢেঁড়স, লঙ্কা চাষ করেন। তবে ওই ফসল চাষ করে তো আর বড়সড় লাভের মুখ দেখতে পারেন না। তাই আমরা চেয়েছিলাম ওই পতিত জমিতে এমন কোনও অর্থকরী ফসল চাষ করতে। যাতে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে পারেন। এই ভাবনা থেকে স্কোয়াশ ফসলের বিষয়টি আসে। প্রদর্শনী ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে এই চাষে ব্যাপক সফলতা মিলেছে। আগামী দিনে এই চাষের ক্ষেত্র বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিপণনের বিষয়টিও আমরা দেখছি। এ বিষয়ে আমরা সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের সঙ্গে কথা বলব।”
জঙ্গলমহলের এই জেলায় মানবাজার ১ ব্লকে এই ফসল অতীতে ফলে ছিল। তবে এমন সফলভাবে হয়নি। এই ফসল দার্জিলিং-সহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় হয়ে থাকে। সিকিমেও হয়। তবে বাংলার মধ্যে দার্জিলিংয়ে এই ফসল ভীষণই জনপ্রিয়। ওই এলাকায় লাঞ্চ বা ডিনার স্কোয়াশের মেনু পাতে থাকবেই। তবে পশ্চিমাঞ্চল পুরুলিয়ায় এই ফসলকে রীতিমত চেনাতে হচ্ছে কৃষকদের। এর পুষ্টিগুণ যে ভীষণ মাত্রায় রয়েছে তা বোঝাতে হচ্ছে। ফাইবার জাতীয় এই ফসল সহজ পাচ্য। তাই পেটের পক্ষে উপকারী। এছাড়া ক্যানসারও প্রতিরোধ করে। উপশম করে চর্মরোগ। হার্টের পক্ষেও ভালো। এই সবজিতে রয়েছে ভিটামিন এ, ই।
এই ফসল মূলত উত্তর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হারে চাষ হয়ে থাকে। খানিকটা লাউ-র মতো লম্বা হলেও একেবারে মিষ্টি কুমড়োর মত রঙ। তাই ইতিমধ্যেই পুরুলিয়ায় এই ফসলের নাম হয়ে গিয়েছে ‘গাছ ডিংলা’। বনমহলের এই জেলায় চাষীদের মুখে মুখে স্কোয়াশের চেয়ে বেশি ‘গাছ ডিংলা’-র কথা ফিরছে। তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের ফসল পশ্চিমাঞ্চলের রুখা মাটিতে ফলানো খুব একটা সহজ ছিল না। এই চাষে পুরুলিয়ার মত আবহাওয়ায় তিন বার সেচ প্রয়োজন হয়। এই ফসল খরিফ ও রবি দু’ মরশুমেরই। এক মরশুমে এক গাছ থেকে দু’বার ফলন হয়ে থাকে। প্রথমবার ওজন বেশি মেলে। পুরুলিয়ায় খরিফ এবং রবিতে ‘এফওয়ান হাইব্রিড’ জাত ব্যবহার করা হচ্ছে। রালিবেড়া গ্রামে প্রদর্শনী ক্ষেত্রে ২ কাঠা জমিতে ৪০০ গাছ লাগানো হয় ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে। ৪২ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে এর ফলন চলে আসে। ফলে একবার ফলনের মধ্য দিয়ে ঘরে লক্ষ্মী এসেছে। ওই গাছেই আবার ফলন আসছে। পুরুলিয়ার বাজারে এক কেজি এই স্কোয়াশ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। তবে এই দামী সবজি শুধু নতুন ফসলের জন্য নয়। এই ফসল সুস্বাদু হওয়ায় রীতিমতো চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে পুরুলিয়া শহর, পুরুলিয়া এক, দুই ব্লক এলাকায়। ১৫ টাকা কেজি কুমড়োর সঙ্গে ৪০ টাকা দরে এই ‘গাছ ডিংলা’ বা স্কোয়াশ কিনছেন মানুষজন। এখানেই সাফল্য বলছে পুরুলিয়া এক কৃষি দপ্তর। বিধানচন্দ্র মাহাতো নামে কৃষক পুরুলিয়া শহরের বড় হাট সহ একাধিক হাটে এই সবজি বিক্রি করে ইতিমধ্যেই ৫ হাজারের বেশি টাকা রোজগার করেছেন। ওই কৃষকের কথায়, “কৃষি দপ্তর যেভাবে আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিল আমরা সেভাবেই চাষ করেছি। সেই কারণেই ভালো ফলন মিলেছে। ফলে দামও পেয়েছি। নতুন ফসল হিসাবেই যে মানুষজনের আগ্রহ তা কিন্তু নয়। এই ফসল সুস্বাদু হওয়ায় এর কদর বেড়েছে। এই চাষ আরও বড় আকারে করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। “
এই সবজি শুধু তরকারি নয়। ব্যালেন্স ডায়েট-এ এই অর্থকরী ফসল কাজে লাগে। এই জন্য বিভিন্ন হোটেলে এই সবজির চাহিদা অনেক বেশি। তাই ঝাড়খন্ডে এই সবজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। কলকাতা- শহরতলিতে এই সবজির দাম ব্যাপকহারে মিলবে বলে আশাবাদী কৃষি দপ্তর। লাউ চকলির মত করেও এই সবজি খাওয়া যায় বলে এই জেলার কৃষকরা বলছেন। সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের মধ্য দিয়ে কলকাতা ও শহরতলিতে পাঠানোর চিন্তা ভাবনা করছে কৃষি দপ্তর। পুরুলিয়া ১ ব্লক কৃষি দপ্তরের সহকারী প্রযুক্তি ম্যানেজার অমিতাভ দে বলেন, “শীতপ্রধান এলাকার সবজি বলে এখানকার কৃষকদের সন্দেহ ছিল এই সবজির ফলন হবে কিনা। তবে পুরুলিয়াতেতো আর কম শীত পড়ে না। তবে আমরা এই ফসল আমরা গরমেও ফলাচ্ছি। তার চ্যালেঞ্জও নিয়েছি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পাশাপাশি এটি অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদা বাড়ছে। “
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.