শহর নয়, গ্রামেও এখন ব্যাপক চাহিদা মরশুমি ফুলের। বাড়ির উঠোন থেকে ব্যালকনি শখের বাগানে শোভা পায় মরশুমি ফুল। খরচ কমাতে বাড়িতে সহজেই বীজ থেকে তৈরি করা যায় চারা। আবার ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বীজ থেকে চারা তৈরি করেও মুখ দেখতে পারেন মোটা লাভের। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তাপস চৌধুরী।
বেশিরভাগ মরশুমি ফুলগাছের জন্ম বিভিন্ন দেশের ঠাণ্ডা প্রদেশে। আমাদের দেশে এই ফুলগুলি শীতকালে দেখতে পাওয়া যায়। শুধু শহর নয়, বর্তমানে এই ফুলগুলির চাহিদা বাড়ছে গ্রামগঞ্জেও। এই ফুলগুলির চারা তৈরি করার জন্য বিদেশ থেকে বীজ আমদানী করা হয়। কিন্তু বীজ থেকে চারা তৈরি করতে চাষিরা খুব অসুবিধায় পড়েন, যার ফলে প্রতিটি বীজ ১-২ টাকা দামে কিনেও ৩-৪ টাকা দামে চারা বিক্রি করতে হয়। শুধু তাই নয়, আমাদের রাজ্যে এই ফুলগুলির বীজ থেকে চারা তৈরি করা খুব কষ্টসাধ্য কারণ বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি, উচ্চ তাপমাত্রার জন্য। সেই কারণে খুঁটিনাটি তুলে ধরা হল মরশুমি ফুলের বীজ থেকে চারা তৈরির।
মরশুমি ফুলের প্রজাতি: অ্যাসটার, ক্যালেনডুলা, ডায়েনথাস, এসকলজিয়া, কসমস্, পপি, স্যালভিয়া, গাঁদা, ফ্লক্স, রেনানকুলাস, ডেনফিনিয়াম, স্টক্, প্যান্জি, জিনিয়া, হেলিক্রাইসাম, ভারবিনা, সুইট-সুলতান, সুইট উইলিয়াম, অ্যামারেনথাস, সিলোসিয়া, গ্যাজানিয়া, গডেশিয়া, নিমেশিয়া, পিটুনিয়া, নিকোসিয়ামা, হেলিওট্রপ, ডেজি, ন্যাসটারসিয়াম, হলিহক, ল্যাভেটুরা, কারনেশান, কর্ন ফ্লাওয়ার ইত্যাদি।
বীজতলা: যে জমিতে বীজতলা বানানো হবে, সেই জায়গা যেন সারাদিন সূর্যের আলো পায়। স্যাঁতস্যাত কিংবা বর্ষায় কোনভাবে বৃষ্টিতে না ভেজে। গ্রীষ্মকালে বীজতলার মাটিকে ভাল করে শুকিয়ে নিতে হবে। পলিথিন ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে যতক্ষণ না ওই মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। যদি বর্ষাকালে চারা তৈরি করার প্রস্তুতি নিতে হয়, তাহলে বীজতলার উপরে মাচা করে পলিথিন ঢাকা দিতে হবে। যদি কোনও চাষি স্থায়ী বীজতলা তৈরী করেন, সেক্ষেত্রে বীজতলার উচ্চতা কমপক্ষে দু’ফুট হওয়া দরকার এবং ওই বীজতলার নীচের অংশে ছয় ইঞ্চি ইটের টুকরো বিছিয়ে দেওয়ার পর মোটা বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এইভাবে এক ফুট বীজতলা ভরে যাওয়ার পর উপরের বাকি এক ফুট বেলে-দোঁয়াশ মাটি দিয়ে ভরে দিতে হবে। অস্থায়ী বীজতলার ক্ষেত্রে বীজতলার উচ্চতা কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি রাখা দরকার এবং চারিপাশে জল নিকাশির ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। উভয়ক্ষেত্রে বীজতলার আকৃতি ২.৫-৩ ফুট চাওড়া ও ১০ ফুট লম্বা হলে ভাল হয়। দুইটি বীজতলার মাঝখানে একফুট জায়গা ছেড়ে দেওয়া দরকার। বীজতলাতে কি কি দ্রব্যগুলি থাকা দরকার তা নিম্নে দেওয়া হল।
১। মাটি + পাতাপচা সার + পচা গোবর সার + বালি (২:১:১১ )
২। মাটি + ভার্মিকম্পোস্ট + বালি (১:১:১)
৩। মাটি + ভার্মিকম্পোস্ট + পার্ললাইট (১ : ১১)
৪। মাটি + পাতাপচা সার + পার্ললাইট (১:১:১)
৫। কোকোপিট + পার্ললাইট (২:১)
যদি চারা প্লাস্টিক ট্রেতে করা হয়, তাহলে কেবল কোকোপিট + পার্ললাইট বা মস + পার্ললাইট ব্যবহার করলে ভাল হয় উপরোক্ত অনুপাতে। প্রতি তিনবছর অন্তর উপরোক্ত দ্রব্যগুলি বদলে দিতে হবে। বীজ ফেলার ১৫ দিন আগে উপরোক্ত দ্রব্যগুলিকে বীজতলাতে বিছিয়ে দেওয়ার পর একভাগ ফর্মালিন বা ফরমেলডিহাইডকে ১০ ভাগ জলের সঙ্গে মিশিয়ে বীজতলাকে ভেজাতে হবে অথবা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ৩০ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে বীজতলা ভেজালে উপকার পাওয়া যাবে। যদি উপরোক্ত রাসায়নিক দ্রব্যগুলি না পাওয়া যায় তাহলে জল ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় গরম করে তলাতে ঢালতে হবে এবং ৭দিন কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার পর সূর্যের আলোয় শুকোলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। যদি মাটি খুব অম্ল হয় তাহলে ১০০ গ্রাম কলিচুন প্রতি বর্গমিটারে মেশাতে হবে ঠিক বীজ বোনার ১৫ দিন আগে। প্লাসটিক-ট্রে যদি বীজতলা হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ট্রে-গুলিকে ব্যবহার করার আগে ব্লিচিং পাউডার মেশানো জলে আধঘন্টা চুবিয়ে নিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। বীজতলাতে বীজ ছড়ানোর পর বীজকে ভার্মিকম্পোস্ট/পাতাপচা সার/পচা গোবরসার/কেকোপিট দিয়ে ভাল করে ঢেকে দেওয়ার পর ক্লোরোপাইরিক্স ২ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে বীজতলাকে ভেজাতে হবে। যদি আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা থাকে তাহলে বীজতলাতে বালির পরিমাণ বাড়ালে বীজের অঙ্কুরোদগম হার বাড়তে পারে।
বীজশোধন: সাধারণত যেসব বীজ প্যাকেটে করে আসে, সেগুলি শোধন করে পাঠানো হয়ে থাকে। তবুও বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হারের বৃদ্ধির জন্য ২-৩ ঘণ্টা করে রৌদ্রে ২-৩ দিন দিয়ে বীজতলায় ফেলতে হবে। আবার অনেক বীজ ভাল অঙ্কুরোদগম হয় না, সেক্ষেত্রে বীজকে টিসু পেপারের মধ্যে রাখার পর হালকা ভিজিয়ে নিয়ে প্লাস্টিক প্যাকেটের মধ্যে নিয়ে রেফ্রিজারেটারের মধ্যে রাখতে হবে। যেখানে তাপমাত্রা ৪-৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। এইভাবে ২ সপ্তাহ রাখার পর সরাসরি বীজতলাতে ফেলতে হবে এবং বীজতলার উপর কালো পলিথিন ডাকা দিয়ে অন্ধকার করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না বীজ অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। তারপর রৌদ্রের আলো বীজতলায় ফেলতে হবে, যেমন প্যানজি ফুলের বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। সাধারণত বীজকে একলিটার জলে ২ গ্রাম ব্লাইটক্স মিশিয়ে ৩০ মিনিট চুবিয়ে রাখার পর বীজতলাতে ফেলা হয় বালির সঙ্গে মিশিয়ে। এছাড়াও ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় জলকে গরম করার পর বীজকে তার মধ্যে ভেজানো হয় আধঘণ্টা সময় ধরে, তাতেও বীজ শোধন হয়।
চারার পরিচর্যা: বীজ থেকে যখন চারা বেরোবে তখন ৩-৪ গ্রাম ট্রাইকোডরমা ভিরিডি প্রতি লিটার জলে ভিজিয়ে বীজতলাতে ছড়াতে হবে। অ্যামোনিয়াম কার্বোনেট + কপার সালফেট (১ : ১) তিন গ্রাম/লিটার জলে মিশিয়ে সাতদিন পরে ঢালতে হবে। বীজ থেকে চারা বেরোনোর পর ম্যানকোজেব (৭৫ শতাংশ WP @ ২.৫ গ্রাম/লিটার জলে গুলে বীজ তলাতে ঢালতে হবে, আবার ঠিক ৭ দিন পরে কারবানডাজিম (৫০ শতাংশ WP) ২ গ্রাম/লিটার জলে গুলে বীজ তলাতে ঢালতে হবে। চারার বয়স যখন এক সপ্তাহ হবে, তখন ১২-৬১-০ জলে দ্রবণীয় সারটির ১/২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে বীজ তলাতে ঢালতে হবে। ঠিক আবার এক সপ্তাহ পরে যখন চারার বয়স ১৫ দিন হবে তখন ১৯-১৯-১৯ সারটির ১/২ গ্রাম বা ১০-১০-১০ সারটির ১ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে চারার উপর স্প্রে করতে হবে। চারার বয়স যখন ২২ দিন হবে তখন ১৯-১৯-১৯ সার ১ গ্রাম এবং ইমিডাক্লোরোপিড ১ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে চারার উপর স্প্রে করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.