বাবুল হক, মালদহ: বান্দ্রা স্টেশন থেকে পুলিশের লাঠি খেয়ে ফিরেছেন। এখন অনাহারের জ্বালা সইতে না পেরে পেটে গামছা বেঁধে শুয়ে আছেন বাংলার শতাধিক পরিযায়ী শ্রমিক। মুম্বইয়ের বান্দ্রা তাঁদের কাছে কাজের খনি। ফি-বছর যাতায়াত। কখনও অভুক্ত থাকতে হয়নি। কিন্তু এই লকডাউন যেন বদলে দিয়েছে পরিযায়ী বাঙালি দিনমজুরদের রোজনামচা। খিদের জ্বালায় চোখে ঘুম নেই। পেটে গামছা বেঁধে কতদিন চলবে?
গভীর আক্ষেপের সুরে সাকিরুল বলছিলেন, “শাহরুখ খানের শহরে কাজ করতে এসে কখনও অভুক্ত থাকতে হয়নি। কিন্তু এবার না খেয়ে খেয়ে মরণাপন্ন অবস্থা আমাদের। কিং খানের বাড়ির উঠোনে বাংলার শ্রমিকরা অনাহারে থাকবেন, তা কখনও ভাবতেই পারিনি। হাতজোড় করে বলছি, আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করুন। নইলে অনাহারে মরেই যাব।” শাহরুখ খানের ‘মান্নত’ থেকে বেশি দূর নয়। হাড়ভাঙা খাটুনির ফাঁকে অন্তত একবার কিং খানের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে সেই ছবি পরিজনদের কাছে পাঠিয়ে আশ্বস্ত করেন ওঁরা। মাত্র প্রায় দু’মাস আগে আসা। এবারও বান্দ্রায় এসে কিং খানের বাড়িটা দেখে এসেছেন। সাকিরুলদের দিনমজুরি ঠিকঠাক চলছিল। রোজ সকালে বাণিজ্যনগরীর রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। শ্রমিকদের ভাষায় সেটি ‘নাকা’। অর্থাৎ শ্রমিক বাজার। সেখান থেকেই স্থানীয়দের ডাক পেয়ে তাঁরা কাজ করতে যেতেন। দৈনিক মজুরি মিলত। কোনও কোম্পানি বা ঠিকাদার সংস্থার অধীনে কাজ করলে কখনও খাবারের সমস্যা হয় না। কিন্তু সাকিরুল শেখরা ‘ডে লেবার’। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে সরাসরি মজুরি পান। এখানেই সমস্যাটা।
মালদহের গঙ্গা নদীর পাড়ে মোথাবাড়ি থানার পঞ্চনন্দপুর গ্রামে বাড়ি সাকিরুলদের। ওই এলাকার অন্তত দু’শো জন শ্রমিক মাস দুয়েক আগে মুম্বইয়ে কাজ করতে যান। মুম্বইয়ের বান্দ্রা স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ। একটা বহুতল আবাসনে তাঁরা ওঠেন। কিন্তু হঠাৎ বদলে যায় সবকিছু। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা দেশে চলছে লকডাউন। আর তার জেরে দেশবাসীর মতোই বন্দিদশায় দিন কাটছে ওঁদের। কিন্তু সমস্যাটা এটা নয়। শাহরুখ খানের শহরে ‘খেতে পাচ্ছেন না’। এটাই আক্ষেপ বাংলার সাকিরুলদের। মালদহের পঞ্চনন্দপুর এলাকার বাসিন্দা সাকিরুল শেখ বুধবার মুম্বই থেকে ফোনে বলেন, “আমরা প্রায় দু’শো জন এখানে একটি ভাড়া বাড়িতে রয়েছি। আমাদের এখান থেকে বান্দ্রা স্টেশন পায়ে হেঁটে যেতে মাত্র পাঁচ মিনিট লাগে। বাড়ি ফেরার জন্য আমাদের অনেকের ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল দশটায় মোদিজি লকডাউন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তাহলে আমাদের ট্রেনের টিকিট কাটতে দেওয়া হয়েছিল কেন? বিকেল তিনটে নাগাদ সবাই বান্দ্রা স্টেশন যাচ্ছিলেন। শুনে আমরাও গিয়েছিলাম। পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করতেই আমরা পালিয়ে আবার রুমে ফিরে আসি। আমাদের দু’-একজনকে পুলিশের লাঠি লেগেছে। তবে চোট সামান্য।” এরপরই সাকিরুল কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে কোনও খাবার নেই। না খেয়ে রুমে সবাই শুয়ে রয়েছে। বাঁচব কিনা বলতে পারছি না। আমাদের মালদহের এমপি আবু হাসেম খান চৌধুরি ডালুবাবুকে ফোন করেছিলাম। ডালুবাবু বান্দ্রার দু-তিনজন নেতার ফোন নম্বর আমাদের দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এদের ফোন করলে খাবার দেবে। কিন্তু খাবারের কথা বলতেই বান্দ্রার ওই লোকগুলো ফোন কেটে দিচ্ছেন। এভাবে না খেয়ে বাঁচব না। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি কোনও ব্যবস্থা করেন কিংবা শাহরুখ খানকে মমতাদি যদি বলে দেন তাহলে আমাদের অনাহারে মরতে হবে না।”
বান্দ্রার বিক্ষোভের ঘটনার পর সেখানে আটকে পড়া শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আপনারা ভিনরাজ্যের শ্রমিক হলেও আমার রাজ্যে আপনারা সুরক্ষিত। উদ্বেগের কোনও কারণ নেই।’’ কিন্তু মালদহের সাকিরুলদের খবর নেয়নি উদ্ধবের প্রশাসন। সরকারি খিচুড়িও মেলেনি। অনাহারে বন্দিদশায় শতাধিক বাঙালি শ্রমিক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.