গৌতম ব্রহ্ম, পাটনা : কত সময় ধরে ধ্যান করছেন কে জানে? একেবারে প্রস্তরবৎ। মুখে অদ্ভুত এক আলো। কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বোধিবৃক্ষের নিচে একমনে ধ্যান করে চলেছেন এক তরুণ বৌদ্ধ লামা। বজ্রাসনের আশপাশে মাঝারি মাপের ভিড়। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কয়েকজন পর্যটক নাগাড়ে কথা বলে চলেছেন। কিন্তু ধ্যানমগ্ন তরুণ লামার কোনও হেলদোল নেই। তাঁর মন হয়তো এখন অন্য জগতে বিচরণ করছে। এখানে বসেই বোধি লাভ করেছিলেন তথাগত। এটাই সেই এপিসেন্টার। গাইড সুরিন্দর কুমারকে টাকা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। চালক সঙ্গী বিনোদ কুমার এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে ঢুকল। গরম রুটির সঙ্গে ফুলকপি-আলুর তরকারি। মন আলো করে তখনও সেই তরুণ লামা।
হঠাৎ চোখ গেল রেস্টুরেন্টের দেওয়ালে, বাঁধানো কয়েকটি ছবিতে। কোনওটায় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, কোনওটায় মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ভিভিআইপিদের সঙ্গে এক ফ্রেমে বন্দি রেস্তোরাঁ মালিকের দাদা রোটারিয়ান এ বিক্রম। মালিক লক্ষ্মী সিং। জানালেন, তাঁর দাদা সমাজসেবী। একটা বড় ট্রাস্ট চালান।
বাইরে বেশ গরম। রাস্তায় পা ফেলা যাচ্ছে না। মালিকের নির্দেশে এয়ারকুলার চলল। শুরু হল কথাবার্তাও৷ ‘বছর দশেক আগে এই শান্তিটুকুও দিতে পারতাম না দাদা, দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত। এখন লোডশেডিং হয় না বললেই চলে’, বলছিলেন লক্ষ্মী। আরও জানালেন, ‘আগে গ্রামের রাস্তায় লোকে সাইকেল চালাতে চাইত না। এখন দু-চাকা, চার-চাকা দিব্যি বাড়ির দোরগোড়ায় চলে আসছে। বিহার অনেক বদলে গেছে দাদা।’
খাওয়ার পর কোল্ড ড্রিংক নিলাম। দু’চুমুক দিয়েই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। মালিককে নিচু স্বরে বললাম, ‘হার্ড ড্রিংকস হবে নাকি?’ হেসে উঠলেন লক্ষ্মী। বললেন, ‘দাদা, সেই বিহার আর নেই। নীতীশজি মদ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন বহুদিন। এখন অনেক ভাল আছি। আগে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাস্তায় উলটে পড়ে থাকত কতজন। এখন সেই মানুষগুলোই বউ-বাচ্চার জন্যে খাবার নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ব্যবসা বেড়েছে। এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বেড়েছে। রাত দেড়টাতেও বাড়ি ফিরতে এখন ভয় লাগে না। আর আগে রাত দশটার পর রাস্তায় বেরতে বুক কাঁপত।’ একা লক্ষ্মী নন, একই কথা জানাচ্ছেন শহরের অন্য মহিলারাও। মনে হল, নীতীশের ছত্রছায়ায় নতুন করে বোধি লাভ হয়েছে বিহারের। বুদ্ধের অন্যতম উপদেশ তো কোনও অনিষ্টকারী প্রলোভনে পা না দেওয়া৷ তা যেন সহসাই বুঝতে পেরেছেন আমজনতা৷ নতুন এক বোধ যেন জাগ্রত হয়েছে বিহারবাসীদের মনে। বাড়ছে আত্মমর্যাদা।
বোধগয়া থেকে গয়া ফেরার পথে অবশ্য গয়া সম্পর্কে বিরূপ ধারণাই হচ্ছিল। ব্রহ্মযোনি পাহাড় ডান দিকে রেখে আমাদের গাড়ি বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভের মতোই ছুটছিল। হঠাৎ উৎকট গন্ধ লাগল নাকে। পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। গয়া আসার আগে অনেকেই সাবধান করেছিলেন। গয়া নাকি খুব নোংরা শহর। যত্রতত্র ময়লা ফেলা গয়াবাসীর মজ্জাগত রোগ। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটা গোবর পচা আর ঘুঁটের গন্ধ। ময়লা এখন যেখানে-সেখানে ফেলা যায় না। প্রতি ১০০মিটার অন্তর ঘূর্ণায়মান ডাস্টবিন। তাতেই ময়লা ফেলার অভ্যাস করে ফেলেছে গয়া। জেডিইউ নেতা রাজু বর্ণাবল জানালেন, গয়া আর বোধগয়ার মধ্যে ফারাক কমছে। পুর-নগর উন্নয়ন দপ্তর প্রচুর টাকা বরাদ্দ করেছে গয়া,পাটনা-সহ ১১ শহরের জন্য। সত্যি বদলে গিয়েছে বিহার।
রাস্তা জুড়ে আগে খানাখন্দ ছিল। ৩ মাসের বেশি টায়ার চলত না। আর এখন বছর ঘুরলেও অসুবিধা হচ্ছে না। ফল্গু নদী পারাপারের সেতু চওড়া হচ্ছে। সীতাকুণ্ড, বিষ্ণুপদ মন্দিরসহ গয়ার পর্যটন কেন্দ্রগুলো সেজে উঠছে। সীতাকুণ্ডর পুরোহিত মদন পান্ডে অবশ্য সব থেকে বড় পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করলেন। বললেন, ‘লালু ছিলেন যাদবদের মুখ্যমন্ত্রী। ওঁর জমানায় যাদবদের প্রচুর উন্নতি হয়েছে। বাকিরা অন্যায়ের শিকার হয়েছে। কিছু ভাল লাগলেই যাদবরা কেড়ে নিত। তা সে মোটর সাইকেল হোক বা সুন্দর নারী। যাদবদের নজর পড়েছে তো গেল। নীতীশ এই জঙ্গলের রাজত্ব শেষ করেছেন।’ আবারও বোঝা গেল, সত্যিই বদলে গিয়েছে বিহার।
শুরুর অভিজ্ঞতা অবশ্য মোটেই এরকম ছিল না। গয়া স্টেশন থেকে বাইরে পা রাখতেই কানে ভেসে এসেছিল এক ঘোষণা, ‘প্রতারিত হবেন না। সরাসরি আমাদের অফিসে যোগাযোগ করুন। ভারত সেবাশ্রমের নাম করে অনেকে লোক ঠকানোর কারবার করছে। এদের থেকে সাবধান থাকুন। মাল নিজের দায়িত্বে রাখুন।’ তাড়াতাড়ি দু’পকেটে হাত গুঁজে দেখে নিলাম। না, মোবাইল, মানিব্যাগ সব ঠিক আছে। হোটেলে যাওয়ার পথে অটোচালকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, শুধু ভারত সেবাশ্রমের নামেই পাঁচটা আশ্রম খুলেছে। তাই এত সাবধানতা। এখন পুলিশ প্রশাসন অনেক বেশি তৎপর। পান্ডারাও আর আগের মতো নেই। কিন্তু ‘সাবধান’ করার অভ্যাস রয়ে গেছে৷ বিহারের ভাবমূর্তি আর খারাপ হোক, চান না বিহারিরা।
ভোটের হাওয়া কেমন? প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে জনৈক ভদ্রলোক বললেন, ‘নতুন নাকি দাদা? এখানকার বাচ্চারাও জানে নীতীশ কুমারের দল জিতবে, আর আপনি জানেন না?’ সত্যি, জয় নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। মন্দিরের পুরোহিত থেকে অটো চালক সবাই আগ্রহী জয়ের মার্জিন নিয়ে।২০১৪তে লাখখানেক ভোটের ব্যবধানে জিতেছিল বিজেপি। এবার নীতীশের জেডিইউ আর রামবিলাস পাসওয়ানের এলজেপি-র জোট হয়েছে। গয়াতে এবার প্রার্থী দিয়েছে জেডিইউ। মোদি-নীতীশের ছবি সামনে রেখেই চলছে প্রচার। তাই জয়ের মার্জিন দ্বিগুন হবে বলেই মনে করছেন এঁরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.