গৌতম ব্রহ্ম: কোনও হিসেবেই মেলে না। অতিমারীর (Corona Pandemic) আতঙ্ক মানসিক স্থিতি পুরো গুলিয়ে দিচ্ছে, বিচিত্র সব অনুভূতি গ্রাস করছে। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কোভিড।
চন্দ্রাণী হাঁসদার কথাই ধরুন। কখনও ওঁর মনে হচ্ছে কেউ করাত দিয়ে শরীরটাকে দু’ভাগ করে দিয়েছে। কখনও মনে হচ্ছে, শরীরে মজুত সব জল জমে হঠাৎ বরফ হয়ে গেল! ‘দ্বিখণ্ডিত’ শরীর নিয়ে সে কী অশান্তি! দুর্বিসহ মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় ভাবছিলেন ওই গৃহবধূ।
ঢাকুরিয়ার এক প্রৌঢ় আবার নিজেকে ‘বডি’ ভাবতে শুরু করেছেন। বেঁচে আছেন, এই বোধটাই বেবাক হাপিস। ক্ষণে ক্ষণে ছেলেমেয়েদের ডেকে ডেকে বলছেন, “ওরে, তোরা কি আমার সৎকার করবি না? এভাবেই ফেলে রেখে দিবি? মরা বাসি হওয়া ভাল? যা, যা, তুলসীপাতা নিয়ে আয়, আমার চোখে দে।”
এমন অনেকেই আছেন। কোভিড যাঁদের মনপাখিকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। কেউ সামলে উঠতে পারছেন, কেউ হেরে গিয়ে নিজেকে শেষ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। কেউ মনোবিদের কাছে পৌঁছচ্ছেন, কেউ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন কানাগলিতে। ‘কোভিড ইনডিউসড সিভিয়ার সাইকোটিক ডিসঅর্ডার’ বেড়েই চলেছে। ব্যস্ততা বেড়েছে শহরের সাইকিয়াট্রিস্টদের।
সম্প্রতি এমন চারজন রোগী পেয়েছেন ইনস্টিটিউ অফ সাইকিয়াট্রির অধিকর্তা ডা. প্রদীপ সাহা, যাঁদের মধ্যে অন্যতম চন্দ্রাণী হাঁসদা। চন্দ্রাণী জানালেন, মাস তিনেক ধরে তাঁর ভয়ংকর অনুভূতি হচ্ছে। শরীর যেন দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যেন কেউ করাত দিয়ে কেটে ফেলেছে, ইন্দ্রজালের মঞ্চে যেমনটা দেখা যায়। পাশাপাশি শরীরের সব জল জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে, গলাটাকে কেউ নাটবল্টু দিয়ে আটকে দিয়েছে ঘাড়ের সঙ্গে। “সে যে কী ভয়াবহ, মনে হয় মরে যাওয়া ভাল।” কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারবাবুদের বলেছেন রোগিণী। ওষুধের জোরে এসব অনুভূতি গায়েব হতে দেরি হয়নি, সাত দিনেই চন্দ্রাণী বিলকুল সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু অনেকেই লজ্জায় সাইকিয়াট্রিস্ট্রের কাছে যাচ্ছেন না। ফলে মনের অসুখ বেড়েই চলেছে। কেন?
বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, কোভিডের জেরে লোকজন এখন ঘরবন্দি। আশপাশে বহু মানষ আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছেন। দেখেশুনে মৃত্যুভয় অনেককে গ্রাস করছে। মনের উপর ওই অস্বাভাবিক চাপ কেউ কেউ সামলে নিতে পারলেও কেউ কেউ পারছেন না, তাঁরা মানসিক বৈকল্য ও অবসাদের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছেন, অনেকে আত্মহত্যাও করছেন। আসলে ‘ট্রমাটাইজড’ হওয়ার কারণে ওঁদের চিন্তাধারা বা ‘থট প্রসেস’টাই বদলে যাচ্ছে। “বর্তমান সময়ে কেউ অতিমারী দেখেনি। একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু, তারপর এই কোভিড। ভয় পাওয়াটা অস্বাভিক নয়।” পর্যবেক্ষণ প্রদীপবাবুর। সুরাহা কী?
প্রদীপবাবুর পরামর্শ, কোভিড নিয়ে ভয় পাওয়া চলবে না। কোভিড সংক্রান্ত নেগেটিভ খবর থেকে দূরে থাকতে হবে, দরকারে টিভি দেখা, খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করতে হবে। লকডাউনের পজিটিভ দিক খুঁজে বার করতে হবে। ওঁর বক্তব্য, লকডাউন একটা অন্তত উপকার করেছে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর, নিজেদের ভিতরে সুপ্ত থাকা নানা প্রতিভাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। এর ফায়দা তুলতে হবে, যতটা সম্ভব। ওঁর কথায়, “আরও বেশি সৃজনশীলতার অনুশীলন করুন। গান গেয়ে, আবৃত্তি করে, ছবি এঁকে ফেসবুকে পোস্ট করুন, কোনও হাতের কাজ বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করা যেতে পারে। নতুন নতুন রান্নাও দেওয়া যায়।” মোদ্দা কথা, নিজের ভিতরে মজুত সৃজনীশক্তির উন্মেষ ঘটাতে হবে। করোনাতঙ্কের আবহে হানা দেওয়া মনোবৈকল্যের অসুখকে তাহলেই রুখে দেওয়া সম্ভব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.