ছবি: প্রতীকী
গৌতম ব্রহ্ম: এক অদ্ভুত রোগ। বিরলও বটে। জীববিজ্ঞানের প্রাথমিক হিসেবনিকেশ উলটে দেওয়া ব্যাধি! যার জেরে গর্ভবতীর গর্ভে ভ্রূণের বদলে গজিয়ে ওঠে সিস্ট। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে জীবনসংকট।
বাবা-মায়ের থেকে ২৩ জোড়া করে ক্রোমোজোম পেয়ে ৪৬ ক্রোমোজোম বিশিষ্ট নিষিক্ত ডিম্বাণু গঠন হওয়াই দস্তুর। কিন্তু অনেক সময় তা হয় না। মায়ের দিক থেকে পাওয়া ক্রোমোজোম হারিয়ে যায়, শুধু বাবার ২৩টি ক্রোমোজোম নিয়ে তৈরি হওয়ায় ভ্রূণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে অন্তঃসত্ত্বার জরায়ুতে সিস্ট গঠন করে, যা কিনা অনেকটা আঙুরের থোকার মতো দেখতে লাগে।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের চৈতালি মণ্ডলের এমনটাই হয়েছিল। ডাক্তারি পরিভাষায়, বলে মোলার প্রেগন্যান্সি। কিন্তু তা দেরিতে ধরা পড়ায় তৈরি হয়েছিল জীবনসংকট। তার উপর আঙুরের মতো টিউমার পেরিটোনিয়ামে চলে এসেছিল। যোনিদ্বার থেকে শুরু লাগাতার রক্তপাত।
লকডাউনের অচল সময়ে নেমে আসা আকস্মিক বিপর্যয় দিশেহারা করে দেয় মণ্ডল পরিবারকে। দু’টি নার্সিংহোম, সরকারি হাসপাতাল ঘুরে সাত দিন আগে চৈতালিকে যখন পার্ক সার্কাসের ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়, তখন এই যায়-সেই যায় অবস্থা। কোনও অঙ্গই ঠিকমতো কাজ করছে না। হিমোগ্লোবিন নামতে নামতে চারে, বিলিরুবিন দশ ছুঁইছুঁই, রক্তচাপ তলানিতে।
এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে রোগীকে নতুন জীবনদান করলেন চিকিৎসকরা। ন্যাশনালের স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান ডা. আরতি বিশ্বাস জানান, তিনমাস পিরিয়ড বন্ধ। দু’টি নার্সিংহোম, কাকদ্বীপ হাসপাতাল, ডায়মন্ডহারবার মেডিক্যাল ঘুরে রোগী ন্যাশনালে এসেছে। সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। প্রেশার বেশ কম, ৯০ বাই ৬০। পালস ১৪০। পেট ফুলে ঢোল। ইউএসজি-তে ধরা পড়ে, রোগীর মোলার প্রেগন্যান্সি উইথ অ্যাসাইটিস হয়েছে। হিমোগ্লাবিন ৪.৬ গ্রাম, যা বারো থাকা উচিত। বিলিরুবিন ৮ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ, সিভিয়ার অ্যানিমিয়া।
গত রবিবার চৈতালিকে ভরতি করা হয়েছিল। বধূটির আগে তিনটি সিজার হয়েছে, লাইগেশনও হয়। মঙ্গলবার এমআরআই করে দেখা যায়, মোলার টিস্যু সিজারের সেলাইয়ের জায়গা থেকে পেরিটোনিয়াম ক্যাভিটিতে বেরিয়ে এসেছে। পেট ভরতি রক্ত। ন্যাশনালে আসার আগে পাঁচ বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছিল। এখানে আরও পাঁচ বোতল। বারো বোতল ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমাও। এত করেও হিমোগ্লোবিন বাড়ছিল না। উলটে বিলিরুবিন বেড়ে দ্বিগুণ। এমন মুমূর্ষু রোগীর অপারেশনে অ্যানেস্থেশিস্ট রাজি হচ্ছিলেন না।
তবু ঝুঁকি নেন আরতিদেবীরা। লকডাউনের সময় জোট বেঁধে বিপন্মুক্ত করেছেন চৈতালিকে। আরতিদেবীর কথায়, “অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। এমন কেস আমি আমার সারা জীবনে একটাও দেখিনি, এতটাই বিরল। প্রতি দেড় হাজার প্রেসগন্যান্সিতে একটা হয়তো এমন কেস পাওয়া যায়।”
চৈতালির পেট থেকে তিন থেকে চার লিটার রক্ত বের করা হয়েছে! প্রায় আড়াই ঘণ্টার অপারেশনে বাদ পড়েছে পুরো জরায়ু। আইসিইউ থেকে রোগীকে এইচডিইউয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ জেনারেল বেডে দেওয়া হবে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক রোগ। কারণ, জরায়ু থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট টিউমারগুলো অনেক সময় শিরা-ধমনির মধ্যে দিয়ে ফুসফুসে পৌঁছে যায়। ভাগ্যক্রমে সে বিপদ এড়ানো গিয়েছে।
খুশি চৈতালির পরিবার। স্বামী চন্দন মণ্ডল জানালেন, “বৈশাখ মাসে হঠাৎ ওর ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। প্রেগ কালার টেস্ট পজিটিভ আসে। আষাঢ় মাসে যোনিপথ থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করে। লকডাউনের জেরে সার্জন দেখাতে পারছিলাম না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। ন্যাশনালের ডাক্তাররা ঝুঁকি নিয়ে আমার স্ত্রীর প্রাণ বাঁচালেন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.