অর্ণব আইচ: মৃত্যুর ইচ্ছা জেগেছিল অনেক আগেই। তখন প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিল কৃত্তিকা। বড় হয়ে মেট্রো রেলস্টেশনে নামলেই সতর্কীকরণের হলুদ লাইন পার হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকত দশম শ্রেণির ছাত্রীটি। মনে মনে বলত, “একবার যেন পড়েই যাই।” যাদবপুরের জি ডি বিড়লা স্কুলে বাথরুমের মধ্যে ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। এই ঘটনার তদন্তে পুলিশের হাতে বড় ক্লু ওই ছাত্রী কৃত্তিকা পালের লেখা তিন পাতার সুইসাইড নোট। তার মধ্যে দু’টি পাতাই আগে লেখা। হয়তো বাড়িতে বসেই। সেই নোটের সূত্র ধরেই গোয়েন্দারা জেনেছেন বহু বছর আগে তার ‘ডেথ উইশ’-এর কথা। এক পুলিশ আধিকারিক জানান, নোটে একাধিকবার সে লিখেছে ‘স্টাফ’-এর কথা। সেই ‘স্টাফ’ কথাটি কোনও বস্তু বলেই ধারণা তাঁদের। তা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। কৃত্তিকার নোটে উঠে এসেছে “তাদের” কথা৷
‘তারা খারাপ, তারা আমায় আঘাত করে।’ এই ‘তারা’ বলতে ওই ছাত্রী কাদের কথা বলেছে, তা নিয়েও রয়েছে রহস্য। বন্ধুদের উদ্দেশে লিখেছে, ‘আমায় ভুলো না।’ আবার কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই লিখেছে যে, ‘লোকজনের নাকের সামনে দিয়েই যখন চলাফেরা করতাম, তারা আমায় ভুলে গিয়েছিল। এখন তারা আমায় মনে রাখবে।’ কেন কৃত্তিকার এই ক্ষোভ, এই ‘তারা’ই বা কে, তা জানতে ইতিমধ্যেই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষিকা ও কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশ। কৃত্তিকা তার যে সহপাঠীদের সঙ্গে বেশি মিশত, তাদের কয়েকজনের সঙ্গেও পুলিশের কথা হয়েছে। মা ও বাবার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কথা হলেও ফের পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। পুলিশের প্রশ্ন, বাড়িতেও সে আত্মহত্যা করতে পারত। কিন্তু স্কুলেই সে আত্মহত্যা করল কেন, সেই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা হচ্ছে। প্রয়োজনে মনোবিদদের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারে পুলিশ। রবিবার কৃত্তিকার মৃত্যুতে মৌন মিছিলের আয়োজন করেন তার স্কুলের অভিভাবকরা।
পুলিশের এক কর্তা জানান, সুইসাইড নোটে কৃত্তিকা লিখেছে, ছোট থেকেই তার ‘ডেথ উইশ’ বা মৃত্যুর ইচ্ছা ছিল। প্রথম শ্রেণিতেই কোনওভাবে সে জানত, অনেক উপর থেকে পড়ে গেলেই মৃত্যু হবে তার। কিন্তু লাফ নয়। যখন মেট্রো স্টেশনে যেত, তখন হলুদ লাইন পার করে সামনের দিকে সে ঝুঁকত। মনে মনে বলত ‘একবার যেন পড়ে যাই।’ কিন্তু ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেনি।
আবার অজ্ঞাতপরিচয় কারও বিষয়ে কৃত্তিকা নোটে লিখেছে, ‘যেখানেই তাকাই আমি তাদের দেখতে পাই। তারা আমার জন্য আসছে। আমায় যেতেই হবে। আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তারা খুব খারাপ। তারা আমায় আঘাত করে। আমার বাঁচার জন্য যা প্রয়োজন, তারা সবকিছু নিয়ে গিয়েছে। সবকিছুই ধোঁয়াটে। কিছুই যেন সত্যি নয়। সবকিছুই যেন স্বপ্ন। সবকিছুই ফিকে হয়ে যাবে, শুধু ভয়ংকর স্মৃতিটা থাকবে। তারা আমায় ধ্বংস করেছে। আমার যা কিছু, তারা ধ্বংস করবে।” এই ‘তাদের’ সম্পর্কে কেন কৃত্তিকার এতটা আতঙ্ক, তা নিয়ে ভাবছেন পুলিশ আধিকারিকরা। সে কি কল্পনায় এমন কাউকে দেখত, যাকে বা যাদের দেখে সে ভয় পেত? সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে মা-বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। সে নোটে লিখেছে যে, গত কয়েকমাস ধরে তার জীবনযাত্রা পালটে গিয়েছে। ভাল করে ঘুম উধাও, মধ্যরাতে যখন ঘুম ভাঙে, তখন সে কুলকুল করে ঘামছে। জীবনের স্বপ্ন সে বহুকাল আগেই ছেড়ে এসেছে।
গত কয়েক মাস ধরে সে বাড়িতে কী ধরনের আচরণ করত, মা-বাবার কাছ থেকে পুলিশ তা জানতে চায়। আবার বন্ধু ও শিক্ষিকাদের কাছ থেকে পুলিশ জানার চেষ্টা করছে, স্কুলে তার আচরণ কোনওভাবে অস্বাভাবিক ছিল কি না। নোটে একটি জায়গায় সে মা-বাবাকে মিথ্যা কিছু বলেছে বলে জানিয়েছিল কৃত্তিকা। সেই মিথ্যাই বা কী, মা-বাবার কাছ থেকে তা জানার চেষ্টা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.