গৌতম ব্রহ্ম: বহুরূপী, না জাদুকর? প্লাস্টিক সার্জারিতে মানুষের চেহারা যেমন বদলে যায়, কাছের মানুষের চোখও ধোঁকা খেয়ে যায়, করোনার (Corona Virus) ক্ষেত্রেও যেন তা-ই! ভাইরাসের আরএনএ-তে এমন জবরদস্ত কিছু মিউটেশন হয়েছে, যে আরটিপিসিআর যন্ত্র তা ধরতে পারছে না। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে।
এ যেন সত্যি চোর-পুলিশ খেলা। ভাইরাস শরীরে ঢুকে ফুসফুসে পৌঁছে যাচ্ছে, অথচ আরটিপিসিআরে ব্যবহৃত কিট তার নাগাল পাচ্ছে না! ফলে ‘ফলস নেগেটিভ’ হচ্ছে কোভিড রিপোর্ট। আছে অথচ নেই। পরিণামে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় মহাবিভ্রাট। আরটিপিসিআর পরীক্ষার ক্ষেত্রে দু’-তিনটে প্রাইমার ব্যবহার করে অ্যাম্পলিফিকেশন করা হয়। টার্গেট আরএনএ-র উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতেই এই কৌশল। এখন প্রশ্ন, আরএনএ নামক রেলগাড়ির কয়েকটি বগি যদি বদলে যায় কিংবা বাদ চলে যায়, তাহলে কী হবে? প্রাইমার কি উদ্দিষ্ট আরএনএ-কে চিনে নিতে পারবে?
“চিনতে পারে, না-ও পারে।”- এমনই মত ভাইরোলজিস্টদের। ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার জানিয়েছেন, ভাইরাসের চরিত্র বদলের জন্যই নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম। কিছু ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে ডিলিশন মিউট্যান্ট এবং ইমিউন এসকেপ মিউট্যান্টের চরিত্র আছে। এর জেরে কোভিড (COVID-19) শরীরে প্রবেশের পর দ্রুত ফুসফুসে পৌঁছে যাচ্ছে। এই স্পাইক প্রোটিনের ডিলিশন মিউটেশনের কারণেই আরটিপিসিআরে ধরা পড়ছে না করোনা। এখনও পর্যন্ত গবেষণায় জানা গিয়েছে, করোনার স্পাইক প্রোটিনের ৬৯তম (হিস্টিডিন) ও ৭০তম (ভ্যালিন) অ্যামাইনো অ্যাসিড গায়েব হয়েছে। নজরে এসেছে ১৪৪তম অ্যামাইনো অ্যাসিডের (টাইরোসিন) অন্তর্ধানও।
এই ডিলিশন মিউটেশনই এখন ভাইরোলজিস্টদের সবচেয়ে মাথাব্যথার কারণ। বহুক্ষেত্রেই করোনার উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও রোগীর আরটিপিসিআর রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। ফলস নেগেটিভ রিপোর্টের জেরে রোগীর চিকিৎসা শুরু হচ্ছে দেরিতে। বাড়ছে মৃত্যুহার। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. যোগিরাজ রায় জানিয়েছেন, একের পাতার পর কোভিডের নতুন স্ট্রেন শুধু যে দ্রুত ছড়াচ্ছে তা নয়, দ্রুত আঘাত হানছে ফুসফুসে। যা হাই রেজোলিউশন কম্পিউটার টোমোগ্রাফি (এইচআরসিটি)-তে ধরা পড়ছে। ঘষা কাচের মতো চেহারা নিচ্ছে ফুসফুস, অথচ, আরটিপিসিআরে তার আঁচ পড়ছে না! বস্তুত এই জটিলতার জন্যই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে এত বিভ্রান্তি বলে দাবি চিকিৎসকদের।
একই বক্তব্য এম আর বাঙুরের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. শুভ পালের। তিনিও স্বীকার করে নিয়েছেন, “ডাক্তারদের রীতিমতো ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে করোনার এই নতুন অবতার।”
পরিত্রাণের উপায়? ভাইরোলজিস্টদের একাংশের পর্যবেক্ষণ, আসলে যে স্ট্রেনগুলির উপর ভিত্তি করে কিট তৈরি হয়েছে, সেগুলির এতটাই মিউটেশন হয়েছে যে, ধোঁকা খাচ্ছে প্রাইমার। তাই প্রাইমার সেটের কার্যকারিতা পুনরায় পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সোজা কথায়, ভাইরাসের নতুন অবতারের জন্য চাই নতুন সেটের প্রাইমার। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আরএনএ হল নিউক্লিওটাইড পুঁতির মালা। মালার কয়েকটা পুঁতি ‘ডিলিট’ হয়ে গেলে বা চেহারা বদলে ফেললে মালা চিনতে অসুবিধা হতেই পারে। সেটাই হচ্ছে ডাবল মিউট্যান্ট ভাইরাসের ক্ষেত্রে। মিউটেশনের দৌলতে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে মজুত অ্যামাইনো অ্যাসিডের গঠনগত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে ‘রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেন’। যার জন্যই রিসেপটর জাপটে কোষে ঢুকে পড়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছে করোনা। অতি দ্রুত তা ফুসফুসে পৌঁছে যাচ্ছে।
এই সব ক্ষেত্রে ফুসফুসের এইচআরসিটি করার পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তারবাবুরা। তাঁদের বক্তব্য, সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট খারাপ এলে ফের আরটিপিসিআর টেস্ট করা উচিত। এই তথ্যকে মান্যতা দিচ্ছে বিমা সংস্থাগুলিও। ফুসফুসের সিটি স্ক্যান রিপোর্ট খারাপ এলে রোগীর কোভিড রয়েছে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.