অরিন্দম অধিকারী: আমার ছোটবেলা কেটেছে উত্তর ২৪ পরগণার বনগাঁতে। মফস্সল হলেও সেখানকার পুজো জাঁকজমকপূর্ণ। মনে পড়ে বিশ্বকর্মা পুজোর সময়েই বাতাসে পুজোর গন্ধ ম-ম করত। প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ে যেত। বুকের মধ্যে পুজোর আনন্দটা আধখোলা কোল্ডড্রিংসের বুদবুদের মতো বেরোতে চাইলেও ঢাকনা চাপা দিয়ে রাখতাম। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা তখনও শেষ হয়নি। পূজাবার্ষিকী বাড়িতে এসেও তালাবন্দি। পরীক্ষা শেষের দিন স্কুল থেকে ছুটে বাড়ি এসে পত্রিকা নিয়ে বসতাম। ডুবে যেতাম অরণ্যদেব, কাকাবাবু, অর্জুন, কলাবতী, অদ্ভুতুড়ে মানুষজনের জগতে।
মহালয়ার আগের দিন পাড়াতে ফিস্ট হত, থাকত মাংস-ভাত। ভোরবেলা সারা পাড়া একসঙ্গে জেগে উঠত মহিষাসুরমর্দিনীর সুরে। রেডিয়ো শুনতে শুনতেই জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে নিতাম। বাড়িতে টিভি ছিল না, শিশিরসিক্ত ঘাসে পা ভিজিয়ে ছুটতাম মামাবাড়ি— টিভির প্রভাতী অনুষ্ঠান দেখব বলে। ফিরে আসবার সময় ঘাসের উপর শিউলি ফুল দেখে আমার শিশু মনে এক অদ্ভুত আবেগ সঞ্চারিত হত। সে অনুভূতির রসায়ন আজও আমার কাছে এক রহস্য।
মহালয়া আর ষষ্ঠীর মাঝের সময়টাই ছিল সবথেকে প্রিয়। পুজো আসছে, এই অনুভূতিটাই আসল। পুজো এসে গেলে তো মুহূর্তেই শেষ। পুজোর জামা তখন দর্জির দোকানে বানাতে দেওয়ার চল ছিল। দিন গুনে মাপ দিয়ে আসতে হত, নইলে পুজোর আগে হাতে পাওয়া যাবে না। পুজো সংখ্যা পত্রিকা আর নতুন জামার সঙ্গে আর একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ক্যাপ পিস্তল। সারা পুজো ফটাস ফটাস শব্দে পাড়া মাথায় করতাম। আশেপাশের নানা প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসত কিশোর, লতা ও আশার নানান বাংলা গান। যেমন ‘নয়ন সরসী কেন’, ‘ফুল কেন লাল হয়’, ‘ও ময়না গো’ ইত্যাদি। চারদিক থেকে সুরগুলো মিশে গিয়ে একটা অদ্ভুত আমেজ তৈরি করত, যা ছাড়া পুজোর দিনগুলোকে ভাবাই যায় না।
পুজোর লাইটিংয়ে তখনও আধুনিকতা আসেনি, টিউব লাইটই প্রধান। পায়ে পায়ে হেঁটে পুজো দেখে বেড়াতাম। ক্লান্ত হয়ে পড়লে জুটত কোল্ড ড্রিংক বা রোল। পুজোর সময় তখন বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসার চল ছিল। সে এক অন্যরকম আনন্দ। অষ্টমীর লুচি, নবমীর মাংস সব ভাইবোনে মিলে মহানন্দে খেতাম। একাদশীর দিন ভাঙা প্যান্ডেল দেখে বুকটা হা-হা করতো ঠিকই, কিন্তু লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত পুজোর রেশ থেকেই যেত।
বিজয়ার লুচি নিমকি মিহিদানা আসত পাড়ার নানা বাড়ি থেকে। আত্মীয়স্বজন ও চেনা-পরিচিতরা পালা করে এসে বিজয়া করে যেত। ঠিক লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন খেয়াল করতাম দিন ছোট হয়ে গেছে। খেলার মাঠ থেকে ফিরে হাত পা ধুতে গেলে গা শিরশির করে উঠত। বিষাদ-ভরা মনে চাপা ভয়ের আগমন হত, আবার পড়তে বসতে হবে, আবার জীবন গতানুগতিক। আনন্দ ফিকে হয়ে যাওয়ার এই অনুভূতিটাই আমার কাছে হেমন্তের স্মৃতি। সেও পুজোরই অঙ্গ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.