শুভজিৎ মণ্ডল: ১৯৯৭ সালের ২ আগস্ট যুবভারতীর ডার্বিতে চিমা ওকোরির একটা হার্ড ট্যাকল শংকরলাল চক্রবর্তীর জীবনের অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসে। দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল সিনবোন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সে দুর্ঘটনাকে জয় করে ১৯৯৯ সালে কামব্যাক করেছিলেন লাল-হলুদ জার্সি গায়ে। তবে ভাগ্যের পরিহাস এমনই, যে জাতীয় লিগে আইটিআইয়ের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে আবার চোট পান। তাও আবার একই জায়গায়। আর তাতেই ময়দান থেকে হারিয়ে গিয়েছিল মিডফিল্ডার শংকরলাল চক্রবর্তীর নামটা। কিন্তু তাঁর মনোবলের কাছে হার মানতে হয়েছে বিধাতাকেও। তাই তো ফুটবলার হিসেবে যা পারেননি, কোচ হিসেবে তা ফিরিয়ে দিতে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিলেন। আর বুধ-সন্ধেয় তার যবনিকা পতন হল মোহনবাগানকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করে।
গত চার বছর ধরে সহকারীর তকমা গায়ে চাপিয়েই আড়ালে কাজ সারছিলেন। কিন্তু বারবার তীরে এসে ডুবেছে তরী। লিগ জয়ের স্বপ্নভঙ্গ করেছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল। এবার তিনি ছিলেন ফরোয়ার্ড লাইনে। গঙ্গাপারের ক্লাবের কোচিংয়ের দায়িত্ব নিয়েই মনে মনে শপথ করেছিলেন দলকে চ্যাম্পিয়ন করার। তবে পথটা ছিল বেশ দুর্গম। কখনও আর্থিক সংকটের জুজু এসে নাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর শিষ্যদের মনোবল। তো কখনও ক্লাবের অন্তর্কলহে কান ঝালাপালা হয়েছে। কিন্তু ‘বহিরাগত’ এসব আক্রমণ রুখে অর্জুনের মতোই স্থির রেখেছিলেন লক্ষ্যকে। কে বলে ক্ষিদ্দা শুধু থাকে বইয়ের পাতায়! কে বলে সব চরিত্র কাল্পনিক! চিরকালই কোনিদের সাফল্যের পিছনে থাকেন একজন ক্ষিদ্দা। আর ইতিহাসে নাম লিখিয়ে বাগান ফুটবলারদের কাছে ক্ষিদ্দাই তো হয়ে রইলেন শংকরলাল।
ময়দানে পা রাখা স্প্যানিশ, ব্রিটিশ কোচদের ভারী নামগুলির মধ্যে কখনওই তিনি সেভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু নামে কী আসে যায়। শংকরলাল তো বুঝিয়ে দিলেন, খেলার মাঠে পারফরম্যান্সই সব। কোথা থেকে পেলেন এমন সঞ্জীবনী বুটি? দীর্ঘ আট বছর পর সবুজ-মেরুনকে ঘরোয়া লিগ চ্যাম্পিয়ন করে কোচ বললেন, ময়দানে টিকে থাকার শক্তি জুগিয়েছেন তাঁর স্ত্রী পৌলমী। “এক সময় ফুটবলের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল। ভাবতাম সব ছেড়ে দেব। কিন্তু আমার মিসেসই আমায় রীতিমতো রিহ্যাব করিয়ে ফুটবলে ফিরিয়ে আনে। তাই আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি প্রাপ্য আমার স্ত্রীয়ের।” অকপট স্বীকারোক্তি শংকরলালের।
স্ত্রী জোর করাতেই ‘সি’, ‘বি’ লাইসেন্স পাশ করার পর ‘এ’ ডিগ্রিও পেয়েছিলেন। বেটারহাফের কথাতেই কোচিংয়ে আসা। তাই এদিন বারবার শংকরলালের কথায় উঠে এল পৌলমী চক্রবর্তীর নাম। তবে শুধুই স্ত্রী নয়, ক্লাবের দুই কর্তা দেবাশিস দত্ত ও সৃঞ্জয় বোসের প্রতিও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন তিনি। বলেন, “সঞ্জয় সেন সরে দাঁড়ানোর পর প্রাথমিক ধাক্কাটা তাঁরাই সামলেছিলেন। আমার উপর ভরসা রেখেছিলেন। নাহলে সম্ভব হত না।” কিছুটা থেমে যোগ করেন, “পরবর্তীকালে বর্তমান ক্লাব কর্তারাও সাহায্য করেছেন।” কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি এককালের কোচ সুভাষ ভৌমিককেও।
ছোট্ট ফুটবল কেরিয়ারে শংকরলাল বাংলার হয়ে অনূর্ধ্ব ১৬, ১৯ ও ২১ জাতীয় যুব ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। সন্তোষ ট্রফিতেও বাংলাকে সেরা করেছিলেন। জাতীয় দলের জার্সি গায়েও খেলেছিলেন। তবেও ১৯৯৬ সালে মোহনবাগানেই ফুটবল জীবন শুরু করেছিলেন, আর কোচ হিসেবেও সূত্রপাত এই তাঁবুতেই। আর এদিন দলকে চ্যাম্পিয়ন করে যেন সেই বৃত্তই সম্পূর্ণ করলেন স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.