সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শুরুর এখনও দশ দিন কাটেনি। ইতিমধ্যেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গিয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। দুটো করে ম্যাচ হেরেছে দুই দলই। এমন নয় যে লড়াই করে পরাস্ত হয়েছে। বলা যায়, কার্যত আত্মসমর্পণ করেছে ভারতের দুই প্রান্তের দুই দেশ। মিল শুধু ক্রিকেটের মঞ্চে নয়, দুদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়াও প্রবল উত্তপ্ত। সেটার কি সার্বিক প্রভাব পড়েছে ক্রিকেটেও? পাকিস্তান-বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক অধঃপতনে কি রাজনৈতিক অস্থিরতাও সমানভাবে দায়ী? উঠছে প্রশ্ন।
গতবছর রাজনৈতিক পালাবদলের পর নিজেদের ‘স্বাধীন’ বলে দাবি করেছিল বাংলাদেশ। সেই স্বাধীনতার স্বাদ অবশ্য কিছুটা তিক্ত হতে শুরু করেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। হাসিনা পরবর্তী জমানায় হিংসার আগুন বাড়ছে বই কমছে না। ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশের স্বপ্ন থেকে ঘুম ভাঙছে অনেকেরই। জন নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে পথে নেমেছিল বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। ফলে গত বছরের আগস্ট ‘বিপ্লব’ থেকে একেবারে ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ অবস্থা সাধারণ মানুষের।
ক্রিকেটের অবস্থাও সেরকম। সোশাল মিডিয়ায় গর্জন অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্স নীচে নামতে নামতে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার মুখে। অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘নতুন’ দিনের শুরুটা খারাপ হয়নি। পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে টেস্টে তাদের চুনকাম করে দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ। তারপর? শূন্যতা ছাড়া ঝুলিতে কিছুই নেই। অবশেষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দুর্দশা প্রকট।
রাজনৈতিক পালাবদলের পর বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডেও পরিবর্তন এসেছে। এমন নয় যে, পাপনের আমলেও শাকিবরা বিরাট কিছু উন্নতি করেছিলেন। কিন্তু অন্তত একটা সম্ভাবনা, একটা বিশ্বাস তৈরি করেছিলেন তাঁরা। কয়েকটি ম্যাচে জয় পেয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধেও। কিন্তু সেটাকেই যদি সাফল্যের পরাকাষ্ঠা বলে মনে করা হয় তাহলে মুশকিল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার থেকেও যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভারতকে হারানো। পালাবদলের পর যে ভারতবিদ্বেষ ওপারের রাজনীতির প্রধান উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে, ক্রিকেট সমর্থকদের হাবেভাবে তো সেটার প্রভাব স্পষ্ট। নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার পর মুস্তাফিজুরদের আচরণে বিরাট কোনও হতাশা চোখে পড়েনি। শান্ত যতই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার জন্য এসেছি বলে আসুন না কেন, বাস্তবের ছবিটা আদৌ সেরকম নয়।
এর মধ্যে শাকিবকে নিয়ে হাজারও জলঘোলা। তিনি খেলবেন কি, খেলবেন না, সেটা নিয়েই তাঁদের দীর্ঘদিন কেটে গিয়েছে। একই অবস্থা ছিল তামিমকে নিয়ে। বাড়ি পোড়ানো হয়েছিল মাশরাফি মোর্তাজার। তিনি তো সে অর্থে বাংলাদেশের ‘কিংবদন্তি’। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যেখানে এরকম ভয়ানক, সেখানে নিরাপত্তার সমস্যায় তো যে কোনও ক্রিকেটার ভুগবেন। বিসিবি কি কাউকে নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিতে পেরেছে? অধিকাংশ দল যেখানে ধারাবাহিকভাবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রস্তুতি নিয়েছে, বাংলাদেশ তখন ব্যস্ত ছিল ‘বিপ্লবে’। মাঝে একপ্রস্থ নাটক চলেছে ‘বিপিএল’ নিয়ে। সমর্থক থেকে ক্রিকেটার, সবার কাছেই দুর্দশার ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। একটা সম্ভাবনা ছিল যে, নতুন উদ্যম নিয়ে নামতে পারেন মুশফিকুররা। কিন্তু হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ল না। বাংলাদেশ পড়ে রয়েছে সেই তিমিরেই। ক্রিকেটের অবস্থাও সেরকমই।
ওপার বঙ্গের রাজনৈতিক গোলযোগ কয়েক মাসের ঘটনা। আর পাকিস্তানে তা বহুযুগের কাহিনি। কট্টরপন্থীর আগ্রাসনের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের বসবাস। পালাবদল ওখানে প্রায় প্রতি দশকের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব সাম্প্রতিক বলতে ইমরান খানের জেলবন্দি হওয়া। যে ইমরান ছিল তাদের কাপ্তান, পরে প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের একমাত্র বিশ্বকাপ জয় তাঁর হাত ধরে। ক্রিকেটার ইমরানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন আক্রম, ইনজামাম থেকে ইউনুস খানরা। এখন সেসব যেন আদি প্রস্তর যুগের ঘটনা। ভারত-পাক ক্রিকেট যুদ্ধের ব্যাটনও দীর্ঘদিন তাদের হাতে ছিল। আর বর্তমানে ভারতের জয় অত্যন্ত স্বাভাবিক। অন্যথা হলেই আশ্চর্যের।
ইতিমধ্যেই পাকিস্তান থেকে বলা হচ্ছে, এই অধঃপতনের জন্য একমাত্র ইমরান দায়ী। তিনিই নাকি ঘরোয়া ক্রিকেটে রাজনীতি ও স্বজনপোষণ ঢুকিয়েছেন। ধরে নেওয়া যাক এই অভিযোগ সত্য। কিন্তু সেখানে থেকে উত্তরণের পথ কি? কেউ খুঁজেছে? আর বর্তমানে যিনি পিসিবি-র চেয়ারম্যান, সেই মহসিন নকভি আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্থাৎ হাতে ক্ষমতার অভাব নেই। তাহলে কি সদিচ্ছার অভাব? চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আয়োজনে চূড়ান্ত দুর্দশা চলছে। রাষ্ট্রের সাহায্য পেয়েও এত দৈন্যদশা কেন? প্রশ্ন অনেক, উত্তর অজানা। আদৌ সেই সমস্যার সমাধান আছে কিনা কেউ জানে না। দেনায় ডুবে আছে পাকিস্তান। মূল্যবৃদ্ধি আকাশচুম্বী। এই পরিস্থিতিতে ক্রিকেটের সাফল্য দিয়ে কিছুদিন চুপ রাখানো যায়। কিন্তু বোর্ডের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে ক্রমশ গোলিয়াথ থেকে ডেভিডে পরিণত হয়েছে পাক ক্রিকেট।
তাহলে প্রশ্ন উঠবে, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আফগানিস্তান কীভাবে সাফল্য পাচ্ছে? বিশেষজ্ঞ মহল একাধিক যুক্তি দিচ্ছে। প্রথমত, আফগানিস্তানের অধিকাংশ ক্রিকেটার দেশের বাইরে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খেলে বেড়ান। তাছাড়া আফগানিস্তানের উত্থান ঘটেছে সম্প্রতি। এখনও বিরাট কোনও সাফল্য অর্জন করেনি। ফলে তাদের পরীক্ষা বাকি রয়েছে। রশিদরা অন্তত ক্ষুধা দেখাতে পেরেছেন ভালো কিছু করার। নিজেদের প্রমাণ করার। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে আজ সেটুকুরও অভাব। ভারতের দুপাশে দুই দেশ। দুজনেই সমান তালে অধঃগামী।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.