রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: কেকেআর (KKR) কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতকে দেখলাম, রবিবাসরীয় প্রাক্ গুজরাট যুদ্ধের ইডেনে হাতে একখানা চিরকুট নিয়ে ঘুরছেন। এবং জনে-জনে সে কাগজের টুকরো দেখাচ্ছেন! কখনও প্লেয়ারকে। কখনও টিম মেন্টর ডোয়েন ব্র্যাভোকে। অধুনা ফোন ক্যামেরার উন্নতি এতই প্রভূত হয়েছে যে, মাঠের কোন প্রত্যন্ত প্রান্তে কী ঘটছে, কী চলছে, জানতে-বুঝতে বিশেষ সময় লাগে না। ক্যামেরা লেন্স ‘জুম’ করে দিলেই চলে। সে সমস্ত ‘কারসাজি’ করতে-করতে পণ্ডিতের হাতের চিরকুট নজরে পড়ল বটে, কিন্তু তাতে কী লেখা বিশেষ বোঝা গেল না। নিশ্চয়ই টিম কিংবা ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে কিছু একটা হবে!
সমাপতন মনে হতে পারে। কিন্তু অভিষেক নায়ার (Abhishek Nayar)-উত্তর কেকেআর ট্রেনিং দেখলে, তার অনুচ্চারিত নির্যাস মন দিয়ে বুঝলে, আরও একটা ‘লিখন’ ক্রিকেট তর্কবাগীশদের খেয়াল করা উচিত। আর সেটা কেকেআর কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতকে নিয়েই একটা ‘লিখন’! অবশ্যই তা দৃশ্যমান নয়। পূর্ণ অদৃশ্য। অবশ্যই এ নিয়ে কোনও সরকারি বয়ান নেই (এ সমস্ত ক্ষেত্রে কখনও থাকেও না)। কিন্তু পারিপার্শ্বিক থেকে সংগ্রহ করা কিছু-কিছু খবর, কিছু চাক্ষুষ করা কায়িক দৃশ্যপট, একটা প্রাথমিক আন্দাজ যে দিয়ে যায়। আর সে বিচারে, কেকেআর কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের উপর চাপ বাড়ছে। নিঃসন্দেহে বাড়ছে! ঠিক যতটা বাড়ছে তাঁর টিম কেকেআরের উপর!
রবিবাসরীয় ইডেনে সন্ধেয় ওয়াকিবহাল মহলের কেউ কেউ বলছিলেন, কেকেআর যে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে, জাতীয় দলের সহকারি কোচের চাকরি যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পুনরায় পুনর্বহাল করল, তা একটাই বিষয় বোঝায়–অভিষেক নায়ারের উপর টিমের আস্থা আজও ঠিক কতটা? যা ঘটনা। এ দিনই ইডেনে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম, ক্রিকেটাররা নায়ারের উপর এতটাই আস্থা রাখেন যে, প্রয়োজনে তাঁর মুম্বইয়ের বাড়িতে যেতে দ্বিধাবোধ করেন না! বছর ছয়েক পূর্বে রিঙ্কু সিং (রিঙ্কু তখনও আজকের রিঙ্কু হননি) এবং অঙ্গকৃষ রঘুবংশী (সে সময় সবেমাত্র প্রতিভার দ্যুতি ছড়ানো শুরু করেছেন) অভিষেকের বাড়িতে তিন মাস ছিলেন স্রেফ নিজের ক্রিকেটের উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে! এটাও বলা হল যে, মুম্বইয়ের নায়ারের বাড়িতে একটা তলা ছেড়ে আছে ক্রিকেটাররা এসে থাকবেন বলে! একদিক থেকে ঠিকই আছে। যাঁর অবদান নিয়ে প্রকাশ্যে কেএল রাহুল, শ্রেয়স আইয়াররা বলেন, রোহিত শর্মা গুরুত্ব দেন, তাঁর ‘গুরুকুলে’ যে তরুণ প্রজন্ম পড়ে থাকতে চাইবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? বরং আশ্চর্যের হল, নায়ার আজ পর্যন্ত কখনও দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচিং করাননি! কিন্তু তাতে কিছু আটকায়ওনি। কেউ কেউ বললেন যে, ব্যাটারদের সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ কনভার্সশনে নায়ার দেশের সেরা!
রোববার কেকেআর ট্রেনিংয়েও দেখলাম, ব্যাটারদের সঙ্গে যোগাযোগ, তাঁদের টেকনিক্যাল বিষয়পত্তর দেখিয়ে দেওয়ার কাজ করছেন একজনই–এক এবং একমাত্র অভিষেক নায়ার! নাহ্, কেকেআর ম্যানেজমেন্ট এখনও তাঁকে কোনও সরকারি কোচিং পোর্টফোলিও দেয়নি। কিন্তু ব্যাটারদের দায়-দায়িত্ব সমপর্মণের সঙ্গে আরও দু’খানা গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। এক, প্লেয়ারদের মানসিক ভাবে তাজা রাখা। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে ‘মেন্টাল অ্যাসপেক্ট’। দুই, মুম্বইয়ে কেকেআর অ্যাকাডেমির দায়িত্ব। যা আগেও তিনি দেখতেন। ভারতীয় দলে যোগ দেওয়ার পর দু’জনকে অস্থায়ী ভাবে যার দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছিল। শুনলাম, বোলিংয়ের দিকটা আবার পুরোপুরি দেখছেন ডোয়েন ব্র্যাভো। তা সে নেটে নিজে বোলিং করে টিমের বোলারদের হাতেগরম সমস্ত দেখিয়ে দেওয়াই হোক কিংবা নেট সেশনের সময়ই তাঁদের তাতানো! নেট সেশনের সময়ই নাকি ব্যাটারদের দেখিয়ে ব্র্যাভো নখিয়া-হর্ষিতদের উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন, ‘‘গেট হিম আউট! গেম হিম আউট অ্যাট এনি কস্ট!’’ এবার প্রশ্ন হল, তা হলে কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের কাজটা কী? নায়ার ব্যাটিং দেখছেন। ব্র্যাভো বোলিং দেখছেন। আলাদা স্পিন বোলিং কোচ রয়েছেন। তা হলে, তিনি পণ্ডিত কী দেখছেন?
কেকেআর টিমের একজনকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করায় গলা খাঁকারি দিয়ে উত্তর এল, ‘ওভারঅল’। যার চেয়ে অস্পষ্ট বিবরণ বোধহয় আর কিছু হয় না! পণ্ডিত নাকি ঘরোয়া ক্রিকেটারদের কারও কারও সঙ্গে কথা-টথা বলছেন। সঙ্গে দু’একজন বিদেশি! কেকেআরের হালচাল দেখে ক্রিকেটমহলের একাংশের প্রভূত মনে হচ্ছে, সোমবার গুজরাট টাইটান্স ম্যাচ যদি সোনালি-বেগুনি জিতে যায়, টুর্নামেন্টে ফের প্রত্যাবর্তন করে, প্লে অফের সড়ক ধরে পুনরায় ছুটতে শুরু করে– সব দুর্যোগ কেটে যাবে। কেকেআর সুখের সংসার হয়ে যাবে আবার। জয় সমস্ত ঝঞ্ঝা কাটিয়ে দেয়। কিন্তু টিমের যদি এ হেন দুর্দশা চলতে থাকে, তা হলে পরের বার পণ্ডিতকে কোচের চেয়ারে দেখতে পাওয়াই অত্যাশ্চর্য হবে। প্রশ্ন হল, টিম খারাপ খেলতে থাকলে, পণ্ডিতকে এবার কোচের সিংহাসনে পুরো আইপিএলেও দেখতে পাওয়া যাবে তো?
কে জানে!
টিমও শুনলাম, পাঞ্জাব থেকে ৯৫ অলআউট হয়ে ফেরার পর বেশ ঝিমিয়ে ছিল। দলীয় সংহতিও নাকি টাল খেয়ে গিয়েছিল কিছুটা। এ দিন কেকেআরের হয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে এসেছিলেন স্পিন বোলিং কোচ কার্ল ক্রো। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ১১২ তাড়া করতে না পারার ব্যর্থতার পর রিভিউ মিটিংয়ে ঠিক কী বলা হল টিমকে? কার্ল বলে গেলেন, ‘‘অন্যান্য ম্যাচের পর যে পারফরম্যান্স রিভিউ হয়, এবারও তাই হয়েছে। বেশি বাড়াবাড়ি আমরা করতে চাইনি। কারণ, সামনে প্রচুর ম্যাচ রয়েছে। সেখানে ভালো খেলাটা জরুরি।’’ জরুরি, ভয়ানক জরুরি। এ মুহূর্তে কেকেআর লিগ টেবলের সাত নম্বরে। এ পর্যন্ত সাতটা ম্যাচ খেলে জিতেছে তিনটেয়, হেরেছে চারটেয়। আইপিএল বিশেষজ্ঞদের ধারণা হল, প্লে অফে যেতে হলে নিদেনপক্ষে চোদ্দোটার মধ্যে আটটায় জিততেই হবে। সঙ্গে প্রয়োজন, ভালো নেট রান রেট। সে দিক থেকে অন্তত বাঁচোয়া। নাইটদের নেট রান এখন (০.৫৪৭)। পরবর্তী ম্যাচগুলো জিতলে যা আরও স্বাস্থ্যবান হবে। কিন্তু আসল শব্দটা হল– জয়! পরিস্থিতি যা, তাতে কেকেআরকে পরবর্তী সাতটা ম্যাচের মধ্যে পাঁচটায় জিততে হবে। যা অসম্ভব নয় মোটেই। তবে কঠিন কাজ।
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ম্যাচে যে পিচে খেলেছিল কেকেআর, গুজরাত টাইটান্সের বিরুদ্ধে সেই বাইশ গজেই নামছে তারা। পিচে টার্ন থাকলে অল্প-স্বল্ল। কিন্তু পিচ নিয়ে আর গোলাগুলি ছোঁড়ার রাস্তায় যাচ্ছে না কেকেআর। টিমের একমাত্র চিন্তা এখন–ব্যাটিং। ব্যাটারদের স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন। এ দিন আন্দ্রে রাসেল আসেননি ট্রেনিংয়ে। কিন্তু ভেঙ্কটেশ-রিঙ্কুরা দীর্ঘ সময় ব্যাটিং মহড়া সেরে গেলেন। রিঙ্কুর আবার পাঁজরে লাগলও থ্রো ডাউন নিতে গিয়ে। ভেঙ্কটেশকে দেখা গেল, হাঁটুতে আইসপ্যাক দিচ্ছেন। গতকাল টিমের পেসার বৈভব অরোরার হাতের তালুতে সজোরে বল এসে লেগেছিল (কেকেআর বলল, তিনি সুস্থ। খেলতে সমস্যা নেই)। আর পাঁচদিন হলে এ সমস্ত নিয়ে দিস্তা-দিস্তা কাগজ ভরিয়ে ফেলা হত। লেখা হত। লেখা হত, টিমের সম্ভাব্য কম্বিনেশন নিয়ে।
রাসেল নাকি রভম্যান (পাওয়েল), কে খেলবেন? বিপক্ষে চার বাঁ হাতি ব্যাটার, মইন আলিকে খেলালে কেমন হয়? তিনি তো বাঁ হাতি ব্যাটারের বাইরে বলটা নিয়ে যেতে পারবেন। মণীশ পাণ্ডেকে কি অঙ্গকৃষের জায়গায় ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে খেলানো হবে? মুম্বইয়ের তরুণ যে বেশ কয়েকটা ম্যাচ ধরে বড় রান পাচ্ছেন না। আচ্ছা, লুভনীত সিসোদিয়াকে লম্বা সময় কিপিং কেন করানো হল? কুইন্টন ডি’ককই বা কেন বসে থাকলেন? গুজরাতের বিরুদ্ধে সিসোদিয়াকে খেলানোর সম্ভাবনা আছে নাকি? তা হলে মিডল অর্ডারে রাসেল-রভম্যান, দু’জনকেই খেলানোর সম্ভাবনা খুলে যায়।
অর্বুদ-অর্বুদ প্রশ্ন। এবং সমস্ত যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। কিন্তু কার আর আগ্রহ রয়েছে তা নিয়ে? আসল হল, জয়। যেন তেন প্রকারেণ কেকেআরকে যে আজ থেকে জিততেই হবে! যা বুঝছি, ইডেনে আজ থেকে একজোড়া অগ্নিপরীক্ষা শুরু হচ্ছে।
কেকেআরের সঙ্গে কেকেআর কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতেরও!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.