প্রবীর দাস: ইদানীং একটা কথা খুব শুনতে পাই, কেন জাতীয় দলে বাঙালি ফুটবলার নেই? কেন কলকাতার আইএসএল দলগুলোতে বাঙালি ফুটবলার নেই? এই কারণটা কেউ কি কখনও বিশ্লেষণ করতে বসেছি আমরা? হয়তো ভাবছেন বাঙালি ফুটবলারের মান নিম্নগামী। সেই ভাবাটাও যে ঠিক নয়, তার প্রমাণ গতবার নরহরি শ্রেষ্ঠারা দিয়ে দিয়েছেন সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়ে। সারাদেশের মধ্যে সেরা হয়েছে বাংলা। তাহলে কেন বাঙালি ফুটবলার উঠে আসছে না? এইবারই আসে সেই উত্তরটা, সুযোগ না পেলে উঠবে কী করে। যেখানে রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস পর্যন্ত বলেছিলেন, কলকাতা লিগে বাঙালি ছেলেদের নিয়ে দল গড়তে। তারপরেও আইএফএ কর্তারা শুনলেন না! বাংলা ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা। অথচ বাঙালি ফুটবলারদেরই উঠে আসার রাস্তা দিতে চাইছে না। বুঝতে পারছি না, বাঙালি ফুটবলার না তুলে এরা ভিন রাজ্যের ফুটবলার খেলানোর জন্য এত ব্যস্ত কেন?
বাঙালি ফুটবলার উঠে আসার সেরা মঞ্চ কলকাতা লিগ। যেখানে দলগুলো প্রথম একাদশে বাঙালি ফুটবলার খেলা বাধ্যতামূলক ছিল মাত্র চারজন। কিছুদিন আগে সেই চার সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে পাঁচে। এগারো জনের মধ্যে মাত্র পাঁচজন ভূমিপুত্র! আমরা জানি যত বেশি সুযোগ পাবে ভূমিপুত্ররা, ততই বেশি ফুটবলার উঠে আসার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সেখানে চারজন কিংবা পাঁচজনে সেই সম্ভাবনাটা যথেষ্টই কম। অন্য রাজ্যের ছেলেরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। আমি বাংলার বাইরেও খেলেছি। তাই বলতে পারি, গোয়া বা অন্য রাজ্যের লিগে দেখেছি সেই অঞ্চলের স্থানীয় ফুটবলারদের ভিড় বেশি। হাতে গোনা অন্য রাজ্যের ফুটবলাররা থাকে। আর আমাদের কলকাতা লিগের দলগুলোতে হয় উলটোটা। অথচ এই সিদ্ধান্তটা একেবারে আমাদের নিজেদের হাতেই রয়েছে। আমাদের ঘরোয়া লিগ। বাংলার ফুটবলের স্বার্থে যদি এগারো জন ভূমিপুত্র দিয়েও দল গড়তে হয়, তাহলেও ক্ষতি কী?
কলকাতা লিগে নিজেদের প্রমাণ করলে তবেই তো আই লিগ বা আইএসএলে তাদের জন্য বিবেচনা হবে। কত গ্রামগঞ্জ থেকে কত ফুটবলার কলকাতা মাঠে খেলার জন্য লড়াই চালায়। কেউ কেউ আছে রাত তিনটের সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরতে স্টেশনে যায়। প্রথম ট্রেন ধরে গড়ের মাঠে অনুশীলনে আসে। আমি যদি নিজের অতীতের দিকে তাকাই, এখনও মনে পড়ে যায় আমার পরিবারের মানুষগুলোর কথা। মানুষের বাড়ি কাজ করত মা। সেই ভোর ভোর বেরিয়ে যেত। বাবা রিকশা চালাত। বাবাও বেরিয়ে যেত সকালে। দাদার খেলা ছাড়তে হয়েছিল আর্থিক অনটনের জন্য। এমন পরিস্থিতির মধ্যে থেকে আমিও সোদপুর থেকে কলকাতা মাঠে আসতাম। সেই লড়াই থেকে আইএসএল খেলেছি। প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার মতো এরকম আরও হাজার হাজার প্রবীর দাস এখনও লড়াই করছে প্রতিদিন। তাদের জন্যই এই কথাগুলো বলা।
বাঙালি ফুটবলাররা সুযোগ পাবে না। তো কী করবে। খেপের মাঠের প্রলোভন থাকে। অনেক বেশি টাকা পাওয়া যায়। চলে যাবে। প্রতিভা থাকলেও কলকাতা ময়দান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে ওরা। এমন কত ফুটবলার আছে, যারা কলকাতা মাঠ খেলতে চায় না। খেপ খেলে বছরে সাত-আট লাখ টাকা উপার্জন করে সংসার প্রতিপালন করে। এই প্রতিভাগুলোকেই তো সুযোগ দিতে হবে কলকাতা লিগে। এদের বদলে বেশি করে সুযোগ পাচ্ছে অন্য রাজ্যের ফুটবলাররা! এই ভূমিপুত্ররাই যখন সন্তোষ ট্রফি জেতে, তখন এদের উপর ভরসা রেখে কলকাতা লিগে পাঁচের আরও বেশি ভূমিপুত্র বাধ্যতামূলক করা যায় না কি? নয়তো গত এক দশকে যেভাবে বাঙালি ফুটবলারদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করেছে জাতীয় স্তরে, তাতে আগামীতে আতশ কাচ দিয়ে বাঙালি ফুটবলারদের খুঁজতে হবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে। অন্তত এটা তো করাই যেত, দলের সবাই বাঙালি ফুটবলার না হলেও, বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যাটা ভিন রাজ্যের ফুটবলারদের থেকে বেশি করা যেত। ৬ জন বাঙালি, ৫ জন ভিন রাজ্য। আর ভিন রাজ্য থেকে এমন কারা খেলতে আসে জানতে খুব ইচ্ছে করে। যদি ভিন রাজ্য থেকে বাইচুং, বিজয়ন, সুনীলের মতো ফুটবলার খেলতে আসে, তাহলেও না হয় বোঝা যেত। ভাবতাম, এদের দেখার জন্য মাঠে ভিড় হবে। স্থানীয় ফুটবলাররা উপকৃত হবে। যাঁরা আসে, তাঁদের থেকে আমাদের বাংলার ফুটবলাররা কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু বুঝবেটা কে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.