সৌরাংশু এবং সৌভাগ্য চ্যাটার্জি: পশ্চিম এশিয়ার একটা ছোট্ট দেশ কাতার। ২রা ডিসেম্বর ২০১০, সবাইকে চমকে দিয়ে ফিফার তদানীন্তন সভাপতি জোসেফ ব্লাটার ঘোষণা করলেন যে ২০২২-এর বিশ্বকাপ (FIFA World Cup 2022) হবে পশ্চিম এশিয়ার কাতারে।
কাতার, যেখানে প্রথম ফুটবল ক্লাব স্থাপিত হয় ১৯৫০-এ, তারা বিশ্বকাপ আয়োজন করবে। কাতার যার কোনও ফুটবলের ঐতিহ্য নেই, তারা বিশ্বকাপ আয়োজন করবে। স্বভাবতই সকলে, বিশেষত পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম হইহই করে উঠল যে এর মধ্যে নিশ্চয় টাকার খেলা আছে। অনেকেই অভিযোগ করল যে, ১৯৯৮-তে ব্লাটারকে ফিফা সভাপতি নির্বাচিত করার সময়ই টাকা লাগিয়েছিল কাতার এবং তখনই নাকি কথা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল যে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন করবে অদূর ভবিষ্যতে।
এসব তো গেল, দেখা যাক কাতারে বিশ্বকাপ (Qatar World Cup) আয়োজন করার কথা ফিফা ঘোষণা করার পর কী কী কাজ হল:
কাতার বিশ্বকাপের আটটি স্টেডিয়াম:
১। লুসালি আইকনিক স্টেডিয়াম
২। আল বায়ত স্টেডিয়াম
৩। স্টেডিয়াম ৯৭৪
৪। আল থুমামা স্টেডিয়াম
৫। খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম
৬। এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামফ
৭। আহমদ বিন আলি স্টেডিয়াম, এবং
৮। আল ওয়াকরা স্টেডিয়াম
এদের মধ্যে, খলিফা স্টেডিয়ামটিকে শুধু নতুন করে তৈরি করতে হয়নি, খালি কিছু মেরামতের কাজ করে নেওয়া হয়েছে এদিক ওদিক। এছাড়া, একটা সংযোজক মেট্রো রেল ব্যবস্থা, প্রতিটি স্টেডিয়ামে যাবার জন্য সাবওয়ে, হোটেল ইত্যাদি। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের খরচ হিসাব করা হয়েছে প্রায় ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগের বিশ্বকাপের খরচের হিসাব যদি দেখি তাহলে দেখব, সবথেকে ব্যয়বহুল বিশ্বকাপ ছিল ব্রাজিল বিশ্বকাপ। পরিকাঠামো এবং অন্যান্য আয়োজনের খরচ ছিল সেখানে মাত্র ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এই বিপুল অর্থ খরচ করার মতো রয়েছে কাতার প্রশাসনের কাছে, কিন্তু ১২ বছরের মধ্যে সামগ্রিক পরিকাঠামোয় পরিবর্তন? এ তো আর এশিয়ান গেমস বা অলিম্পিক নয় যে একই শহরে বিভিন্ন স্পোর্টিং এরিনায় এক পক্ষকালের মধ্যে আয়োজন করা সম্ভব হয়ে। ফুটবলের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার নিরিখে ৩২টি দেশ তো বটেই, বাকি জায়গা থেকেও দর্শক, সাংবাদিক এবং বিশ্বকাপ সংক্রান্ত বাণিজ্য ইত্যাদি অন্যান্য কার্যের জন্য মানুষজন কাতারে আসবেন কাতারে কাতারে। তাদের অনুকূল পরিকাঠামো তো দরকার। তার উপর কাতারে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা দিনের বেলায় স্বচ্ছন্দে ৫০ ডিগ্রির কাছাকাছি উঠে যায়। এই এই বিপুল পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য দরকার ছিল বিপুল পরিমাণ শ্রমিক। দরকার শ্রম আইনে পরিবর্তন। কাতার প্রশাসন জানিয়েছে, ২০১০ সালেই এই পরিবর্তন করে, অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয় মাসিক ২৭৫ ডলার। কাফালা ব্যবস্থার মতো শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী বিভিন্ন নিয়ম বিলুপ্ত করাও হয়।
কিন্তু তাপমাত্রা? কাজের চাপ? অন্যান্য পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থা? দ্য গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, যাঁরা এই বিশ্বকাপের জন্য মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে গিয়ে কাজে যোগদান করেছিলেন, সামান্য দুটো আয়ের আশায়। তাপমাত্রার সমস্যা তো ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক মেরে দেওয়া, থাকার অব্যবস্থা, প্রায় অমানুষিক পরিস্থিতিতে কাজ করার চাপ। আর কাতারের মানবাধিকার রেকর্ড? হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠনটির মতে, কাতার এখনও মহিলাদের সমানাধিকারের পথে অনেকটাই পিছিয়ে। মহিলা কাতারি নাগরিককে দেশ ছাড়ার জন্য এখনও পুরুষ অভিভাবকের থেকে অনুমতি জমা করতে হয়। সমকামিতা কাতারে বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সমস্ত কিছু নিয়েই কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে অবিসংবাদিত বিতর্ক তৈরি হয়েছে যার অধিকাংশই ফুটবল বহির্ভূত। আর ফুটবল সংক্রান্ত বিতর্ক? সে নিয়ে পরের কিস্তিতে আসব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.