বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের ‘অনুপ্রেরণায়’ এই পুজো শুরু। সম্রাটের থেকে ‘রায়চৌধুরি’ উপাধি পান তৎকালীন বাংলাদেশের যশোহর জেলার মহেশপুরের জমিদার। উপাধিলাভের আনন্দ প্রজাদের মধ্যে ভাগ করে নিতে তৎকালীন জমিদার ‘বড় সরকার’ দুর্গাপুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই শুরু। তিনদিন ধরে জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় কবজি ডুবিয়ে পেটপুজো করেছিলেন প্রজারা।
মহেশপুরের সেই জমিদারি নেই। নেই সেই ঠাঁটবাটও। দেশভাগের পর রায়চৌধুরিরা চলে আসেন নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের পাবাখালি গ্রামে। ঠাঁইছাড়া হয়ে সমস্যায় পড়লেও পুজো বন্ধ হয়নি। এখনও নিষ্ঠা সহকারে দুর্গাপুজো হচ্ছে রায়চৌধুরি পরিবারে। রীতি মেনে এখনও সন্ধিপুজোর সময় শূন্যে গুলি ছোড়া হয়। দশমীতে দেবীকে পান্তাভোগ দেওয়া হয়। আর তামাক ভোগ পান শিবঠাকুর। নদিয়া গবেষক মোহিত রায়ের ‘রূপে রূপে দুর্গা’ বইয়ে পুজোর ইতিহাস মলাটবন্দি হয়েছে। রায়চৌধুরিদের চৌত্রিশতম বংশধর পিনাকীপ্রসাদ রায়চৌধুরি এখন পুজো পরিচালনার মূল দায়িত্বে। তিনি জানালেন, দেশভাগের পর রায়চৌধুরি পরিবার মহেশপুর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে পাবাখালি গ্রামে চলে আসে। পাবাখালি একটা সময় মহেশপুরের জমিদারির অংশ ছিল।
ভারত তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। সেই ১৯৪৯ সালে পাবাখালিতে পুজো শুরু করেন রায়ৗচৗধুরিরা। সেই হিসাবে এপার বাংলায় প্রায় সত্তর বছর ধরে এই পুজো চলছে। যদিও ওপার বাংলা এবং এপার বাংলা মিলিয়ে এই পুজোর বয়স পেরিয়ে গিয়েছে তিনশো বছর। রায়চৌধুরি পরিবার ‘দ্বিভুজা’ নামে পূজিত হন দশভুজা। কারণ, সামনে থেকে দেখলে দেবীকে দ্বিভুজা মনে হবে। আসলে কিন্তু দেবী দশভুজা। বাকি আটটি হাত ঢাকা থাকে চুলের আড়ালে। দেবীর ডান হাতে ত্রিশূল। আর বাঁ হাতে সাপের লেজ। দেবী প্রতিমার মাথার উপরে চালচিত্রের বদলে তৃতীয়ার চাঁদের মতো চালি।
দ্বিভুজা দুর্গার পুজো পদ্ধতি ও ভোগের নানা বৈচিত্র রয়েছে। ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন চারবার করে ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। সকালে পাঁচ রকম ভাজা, পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে দেওয়া হয় খিচুড়ি ভোগ। দুপুরে মাসকলাইয়ের ডাল, বিভিন্ন রকম তরকারি দিয়ে দেওয়া হয় অন্নভোগ। বিকেলে দেওয়া হয় পায়েস ভোগ। সন্ধ্যারতির পরে লুচি, সন্দেশ, মোয়া, নাড়ু দিয়ে দেওয়া হয় ভোগ। দশমীতে দেবীকে দেওয়া হয় পান্তা ভোগ। একটা সময় পূর্ণ শাক্ত আচারে রায়চৌধুরিদের পুজোতেও মোষ বলি দেওয়া হত। তবে কোনও একটা অজ্ঞাত কারণে জমিদার শিবপ্রসাদ রায়চৌধুরির সময় বলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
এই পারিবারিক পুজোর বেশ কিছু রীতি রয়েছে। যেমন, পয়লা বৈশাখে ভগবতী যাত্রার দিনে প্রতিমার পাট পুজো করা হয়ে থাকে। রথের দিন দেবী প্রতিমার নির্মাণ শুরু হয়। ষষ্ঠীতে দেবীকে বোধন করে হোমের আগুন জ্বালানো হয়। প্রতিদিনই হোম হয়ে থাকে। দশমী পূজা শেষে হোমের আগুন নেভানো হয়। চণ্ডীমণ্ডপে প্রজ্বলিত এক মোমবাতি শিখার সংকেত মেনে অষ্টমীর সন্ধিপুজো হয়। পুজোর চারদিন চণ্ডিপাঠ হয়ে থাকে। দশমীর দিনে ‘যাত্রামঙ্গল’ রায়চৌধুরিদের দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদিন মহাদেবকে তামাক ভোগ দেওয়া হয়। দশমীতে দেবীর প্রতিমাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে চূর্ণী নদীর জলে নিরঞ্জন দেওয়া হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.