বিশ্বদীপ দে: একসময়ের বন্ধু এখন শত্রু শিবিরে! ব্যক্তিজীবনের মতোই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েই থাকে। ইতিহাস তার সাক্ষী। তবু ভারত-পাক সংঘাতের আবহে তুরস্ক যেভাবে ইসলামাবাদের হাতে হাত রেখেছে তাতে বিস্মিতই হতে হচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি খতিয়ে দেখলে সেদেশের এই আচরণ একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোগানের আমলে গত কয়েক বছরে খোলনলচে বদলে গিয়েছে দেশটার।
অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে বিস্মিত হতেই হয়। তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্ককে গড়ে তুলেছিলেন উদার গণতান্ত্রিক কাঠামোয়। কিন্তু রিসেপ তায়েপ এর্দোগানের হাত ধরে সেই কাঠামো ভেঙে গিয়েছে। বরং ক্রমেই কট্টরপন্থী এক ইসলামিক দেশে পরিণত হয়ে উঠেছে তুরস্ক। আঙ্কোরার ‘পাক-বান্ধব’ হয়ে ওঠায় তাই হয়তো বিস্ময়ের কিছু নেই।
অথচ এমনটাই যে হতে চলেছে তার প্রমাণ মিলেছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই। সেই সময় আয়া সোফিয়া মিউজিয়ামকে মসজিদে রূপান্তরিত করার অনুমতি দেয় তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালত। অথচ একদা আয়া সোফিয়া ছিল গির্জা। কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ সেই গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালে মসজিদকেই মিউজিয়ামে বদলে দেন আতাতুর্ক। কারণ তিনি চেয়েছিলেন তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবেই তৈরি করবেন। সাড়ে আট দশক পেরিয়ে এসে ফের আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করার নির্দেশই যেন বুঝিয়ে দেয় কীভাবে অভিমুখ বদলে ফেলেছে তুরস্ক।
এই যাত্রাকে বুঝতে গেলে একবার গত শতকের দুইয়ের দশক থেকে ঘুরে আসা দরকার। ১৯২৩ সালের ২৯শে অক্টোবর আতাতুর্ক তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেদিন সেদেশের পার্লামেন্টে স্লোগান উঠেছিল, ”গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক।” পরবর্তী ১৫ বছর তিনিই ছিলেন সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তবে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি ‘আতাতুর্ক’ উপাধি পাননি। এর অর্থ ‘তুর্কি জাতির জনক’। এই মানুষটিকে ঘিরেও বিতর্ক ছিল। কিন্তু তিনি যেভাবে তুরস্ককে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গড়ে তুলেছিলেন, তার প্রশংসা সারা বিশ্বের উদারপন্থীরাই করেছেন।
তিনি যে পথে তুরস্ককে গড়ে তোলেন, সেই পথে হেঁটেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল আঙ্কারা। তবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকলেও মিত্রশক্তির সঙ্গে অল্পবিস্তর সম্পর্ক রেখে এবং ইহুদিদের সাহায্য করেছিল তারা। যুদ্ধের পরে রাষ্ট্রসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশও ছিল তুরস্ক। ১৯৫০ সালে তুরস্কে বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তারপর থেকে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী দলগুলিকে পালা করে ক্ষমতায় আসতে দেখা গেলেও সেদেশের প্রশাসনে একটা বড় ভূমিকা ছিল সেনাবাহিনীর। তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার ‘অজুহাতে’ই বেশ কয়েকবার দেশের শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করেছে তারা।
২০০৩ সালে তুরস্কের ক্ষমতা চলে যায় এর্দোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির হাতে। আসলে দেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে জন্ম নেওয়া ক্ষোভই রাস্তা করে দিয়েছিল এর্দোগানকে। দ্রুত নয়, কিন্তু ধীরে ধীরে কট্টরপন্থী হয়ে ওঠেন এর্দোগান। বহু সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দিতে দেখা যায় তাঁকে। এমনকী আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে ধর্মীয় শিক্ষার হয়েও সওয়াল করতে থাকেন। জানিয়ে দেন, নতুন প্রজন্মকে ‘ধার্মিক’ হয়ে উঠতে হবে। একজন একনায়কের হাত ধরে এভাবেই তিলে তিলে বদলে গিয়েছে তুরস্ক।
আর তাই আজ পাকিস্তানের পাশেই দেখা যাচ্ছে আঙ্কারাকে। অথচ তারা বিস্মৃত হল বারে বারে ভারত কীভাবে বন্ধুর মতো পাশে থেকে তাদের। ২০২৩ সালে তুরস্কের ভয়ংকর ভূমিকম্পের কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। প্রকৃতির রোষে প্রচুর প্রাণহানি ও বিপুল সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সময় ভারত উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসক দল পাঠিয়েছিল তুরস্কে। দেড়শো জনের সেই দল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পিছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সময় অবশ্য ভারতে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ফিরাত সুনেল ভারতকে ‘প্রকৃত বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেন। এরও আগে ১৯৯৯ সালে তুরস্কে আরও একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। সেবারও বন্ধুর মতোই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। আবার করোনার ভয়াবহ দাপটের সময় তুরস্ককে ১০০ মিলিয়ন ডলারও দিয়েছিল ভারত। ভ্যাকসিন থেকে পিপিই কিট- অতিমারীর মোকাবিলায় প্রকৃত বন্ধুর কাজই করেছিল নয়াদিল্লি।
কিন্তু এখন সেসব কার্যতই অতীত বলে মনে হচ্ছে। ভারত-পাক যুদ্ধের আবহে পাকিস্তানের সেনাকে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে। ভারতের যাবতীয় সাহায্যের কথা ভুলে গিয়ে যুদ্ধের আবহে পাকিস্তানকে ড্রোন দিয়ে সাহায্য করে তুরস্ক সরকার। এমনকী পাকিস্তানে সেনা পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। বন্ধুর শত্রু শিবিরে চলে যাওয়া মানতে না পেরে তুরস্কের সংস্থা সেলেবির সঙ্গে যাবতীয় চুক্তি বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। বদলে যাওয়া দিনকালে ইতিহাস, এমনকী সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটতে বসলেও তাই অবাক হতেই হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.