বিশ্বদীপ দে: গত মার্চে জাফার এক্সপ্রেসের প্রায় ৫০০ যাত্রীকে অপহরণের ঘটনা সাড়া ফেলেছিল বিশ্বে। জানা গিয়েছিল বালোচ লিবারেশন আর্মির কথা। শেষমেশ অবশ্য পাক সেনা দাবি করে বালোচ বিদ্রোহীদের সকলকেই হত্যা করা হয়েছে। উদ্ধারও করা হয় পণবন্দিদের। তবে অন্তত ২৮ জন সেনাকে বিদ্রোহীরা খুন করেছে বলেও জানা যায়। এরও আগে গত নভেম্বরে কোয়েটা স্টেশনে আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারান অন্তত ৩২ জন। এক্ষেত্রেও হামলার দায় নিয়েছিল বালোচ লিবারেশন আর্মি। অর্থাৎ বালোচ বিদ্রোহীরাই। এভাবেই থেকে থেকে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো জেগে ওঠে তারা। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যার জেরে আজও ভুগতে হয় পাকিস্তানকে। কিন্তু কীভাবে মাত্র ২২৭ দিনের জন্য স্বাধীন হয়েও পাকিস্তানে মিশে যেতে বাধ্য হয়েছিল বালোচিস্তান? মহম্মদ আলি জিন্না কোন ষড়যন্ত্রে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সেই ভূখণ্ড? এই ইতিহাস আজও দগদগে হয়ে রয়েছে বালোচদের কাছে। এই লেখায় আমরা সেই ইতিহাসের পাতাই একবার উলটে দেখব।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন হয় ভারত। একদিন আগে ১৪ আগস্ট। অথচ বালোচিস্তান জিন্নার কূটনৈতিক কৌশলের শিকার হয়ে স্বাধীনতা উপভোগ করেছিল মাত্র ২২৭ দিনের জন্য। বালোচ নেতাদের দূরদৃষ্টির অভাব, ব্রিটিশদের ধূর্ততা এবং অবশ্যই জিন্নার চক্রান্তের কারণেই এই দুর্ভোগ তাদের। মনে রাখতে হবে, দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় বালোচিস্তান আসলে ছিল চার প্রিন্সলি স্টেটের সমন্বয়- কালাত, খারান, লাস বেলা ও মাকারান। এদের কাছে তিনটই অপশন ছিল। ভারতের সঙ্গে হাত মেলানো, পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মেলানো অথবা স্বাধীন থেকে যাওয়া। এখানে একটা বলে রাখা দরকার। ব্রিটিশরা যখন ঘোষণা করল তারা এদেশ ছেড়ে চলে যাবে, সেই সময় ভারতে দেশীয় রাজ্য ছিল ৫৬৫টি। তারা সেই অর্থে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে ব্রিটিশদের বৈদেশিক নীতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু শর্ত তাদের মানতে হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তারা এই দেশের অংশ থাকবে কিনা সংশয় ছিল তা নিয়েই। শেষ পর্যন্ত সেই রাজ্যগুলি যদি স্বাধীন প্রদেশ হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নিত কিংবা পাকিস্তানের অংশ হয়ে উঠত তাহলে আজ আমরা যে মানচিত্র দেখি, দেশের সেই মানচিত্রই থাকত না। তৈরি হত দেশভাগের আরও ক্ষতবিক্ষত এক রূপ। তা হয়নি। যদিও প্রাথমিক ভাবে কাশ্মীর স্বাধীন প্রদেশ থাকাই বেছে নিয়েছিল। তবে সেটা অন্য ইতিহাস।
আমরা এখানে কথা বলছি বালোচিস্তান নিয়ে। জিন্নার প্রভাবে খারান, লাস বেলা ও মাকারান রাজি হয়ে যায় পাকিস্তানের অংশ হতে। কিন্তু কালাত রাজি হয়নি। এমনিতেও এই প্রদেশ বাকি তিনটি প্রদেশের থাকা আলাদাই ছিল। কেননা ১৮৭৬ সালের এক চুক্তিতে তা স্বশাসিত এক ভূখণ্ড। যা ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে কালাতের কোনও দায় ছিল না ভারত বা পাকিস্তানকে বেছে নেওয়ার। সেই প্রদেশের শাসক খান মীর আহমেদ ইয়ার খান বেছে নিলেন স্বাধীন থাকার অপশনটিই। যদিও একটি ভুল তিনি করে ফেলেছিলেন ১৯৪৬ সালে। মহম্মদ আলি জিন্না ছিলেন তাঁর আইনি পরামর্শদাতা। ব্রিটিশদের সঙ্গে যা কিছু মামলা মোকদ্দমা সেসব লড়ার জন্যই তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন কালাতের ওই শাসক।
যাই হোক, ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট দিল্লিতে একটি বৈঠক হল। সেখানে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন, কালাতের শাসক, মুখ্যমন্ত্রী এবং জিন্না-নেহরু উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকে জিন্না দিব্যি মেনে নেন কালাতের স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্তকে। ঠিক হয়ে যায়, ৫ আগস্ট থেকেই কালাতকে স্বাধীন ঘোষণা করা হবে। কেবল তা নয়, খারান ও লাস বেলাকেও বালোচিস্তানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সবই জিন্নার পরিকল্পনা। মুসলিম লিগের সঙ্গে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। জিন্নার দল কথা দিয়ে দেয়, তারা বালোচিস্তানের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না।
সময় যায়। ‘খান অফ কালাত’ আশাপ্রকাশ করেন, ব্রিটেনের সঙ্গে উনবিংশ শতকের সেই চুক্তি মেনে বাকি অংশও ফিরিয়ে দেওয়া হবে তাঁদের। কিন্তু তা তো হলই না। বরং মাউন্টব্যাটেন ফস করে একটি হলফনামা পেশ করে দাবি করেন, বালোচের পক্ষে স্বাধীন প্রদেশ হিসেবে থাকার ক্ষমতাই নেই। আর এই পরিস্থিতিরই অপেক্ষা করছিলেন জিন্না। তিনি দাবি করতে থাকেন, সেক্ষেত্রে কালাত পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাক। সেবছরের অক্টোবরেই কালাতের শাসক পাকিস্তানে আসেন। তাঁকে করাচিতে স্বাগত জানান হাজার হাজার বালোচ। কিন্তু না প্রধানমন্ত্রী জিন্না, না অন্য কোনও রাষ্ট্রনেতা- কেউই তাঁকে স্বাগত জানালেন না। আসলে এটাই ছিল জিন্না প্রশাসনের কড়া বার্তা। সেই সফরেই জিন্না পরিষ্কার জানিয়ে দেন, কালাত যেন পাকিস্তানের সঙ্গেই যোগ দেয়। মীর আহমেদ ইয়ার খান সেই প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করে দেন। কিন্তু জিন্না চাপ বাড়াতেই থাকেন।
অগত্যা কালাতের সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেস ব্রিটিশদের শরণাপন্ন হন। কিন্তু সাহেবরা তাঁদের আর্জিতে পাত্তাও দেননি। বলে দেন, পাক সরকার অনুমতি না দিলে তাঁরা কোনও অস্ত্রশস্ত্র পাঠাবেন না। এমনকী বালোচ সর্দারদের মধ্যেও স্রেফ দু’জনই শাসকের পাশে থাকলেন। বাকিরা মত দিলেম পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষেই। জিন্না এরপরই ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারলেন। খারান, লাস বেলা ও মাকারানকে বালোচ থেকে আলাদা করে নেওয়ার ঘোষণা করে দিলেন। কালাতকে একেবারে একা করে দিলেন। এই পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান ও ভারতের কাছেও সাহায্যের জন্য আর্জি জানাতে থাকেন কালাতের শাসক। কিন্তু সাড়া মেলেনি। কালক্রমে পাকিস্তানের দখলে চলে গিয়েছিল কালাতও। কিন্তু আজও থামেনি বালোচদের প্রতিরোধ।
প্রথমে ১৯৪৮, পরে ১৯৫৮, ১৯৬২, সাতের দশকের শুরুয়াৎ বারবার বিদ্রোহের আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। তবে শেষপর্যন্ত তা রুখে দিতে পেরেছে পাকিস্তান। কিন্তু রুখে দিলেও বিদ্রোহের বীজকে দমন করা যায়নি। তাই আজও সেই আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে। থেকে থেকেই তা উগরে দেয় আগুন! তাছাড়া পাকিস্তান বালোচিস্তান দখল করে নিলেও তার দিকে কোনওদিন নজর দেয়নি। ফলে তা হয়ে থেকেছে সবচেয়ে অবহেলিত ও দারিদ্রক্লিষ্ট পাক প্রদেশ। পাকিস্তানের অর্থনীতির মাত্র ৪ শতাংশ বালোচিস্তানের। অন্যদিকে বালোচের খনি চিনের হাতে তুলে দিয়েছে ইসলামাবাদ। যার ফলে প্রতিনিয়ত ধুঁকতে থেকেছে সেই প্রদেশ। বিদ্রোহের আগুনে তাই যোগ হয়েছে নতুন বারুদ। ইতিহাসের পাতায় থেকে গিয়েছে যে আগুন, তাকেই নতুন করে উসকে চলেছে সেই বারুদের কণাগুচ্ছ। আজও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.